বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও মাতৃদুগ্ধ ভাতার কার্ড চাইলেই কার্ডপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দাবি করেন তিনি। সরকারের ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড দুস্থ-গরিব লোকদের পরিবর্তে দিয়েছেন এলাকার সচ্ছল ও ধনীদের। টিসিবির মাল হতদরিদ্রদের না দিয়ে তা বিক্রি করেন সচ্ছল মানুষদের মাঝে। নিয়ম ভেঙ্গে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ধরনের কার্ড ইস্যু করে নিয়েছেন তিনি।
নড়াইল জেলার লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ তুলেছে এলাকাবাসী। তারা লিখিতভাবে এসব অভিযোগ খুলনা বিভাগীয় অফিস, জেলা, উপজেলা এবং স্থানীয় সরকার বরাবর জানিয়েছে। একইসঙ্গে অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকিরের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও জানিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সেই অভিযোগের কপি এসেছে ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদকের হাতে।
অভিযোগ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সেই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তের খবর জেনে তা ঠেকাতে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নানা জায়গায় তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
তবে ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের দাবি, সব অভিযোগ মিথ্যা। তার বিরুদ্ধে একটি মহল বিভিন্ন দফতরে এসব মিথ্যা অভিযোগ জমা দিয়েছে।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আসলে কয়েকজন লোক আমার কাছে বয়স্ক ভাতার কার্ড চেয়েছিল। আমি একজনকে দিতে পারিনি। তারাই মূলত এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছে। আমি কেমন লোক তা স্থানীয় সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলা স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, যারা ভুক্তভোগী তাদের কয়েকজন এসে কথা বলেছে। কেউ বলেছে সেই মেম্বারকে ভোট দেয়নি বলে তার কার্ড করেনি। কেউ অভিযোগ করেছে তার কার্ড বাতিল করেছে। আমরা অভিযোগ পেয়েছি কিন্তু এখনও তদন্ত করে রিপোর্ট তৈরি করিনি। অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন আমরা দেব। সেই মেম্বার যদি আমাদের নিয়ে এমন কথা বলে থাকে তবে বিষয়টি লজ্জার।
এ বিষয়ে লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার জহুরুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা তার বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত শুরু করেছি। সাক্ষ্য প্রমাণ এবং ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে তদন্ত চলমান রয়েছে। শিগগিরই আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসনকে জমা দেব। তবে আমাদের পাশাপাশি দুদক তদন্ত করলে বিষয়টি আরও ভালো হবে।
এদিকে উপজেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, নুরুজ্জামান ফকিরের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন তারা।
মাতৃদুগ্ধ ভাতার কার্ড নিতে ১০ হাজার টাকা!
মল্লিকপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মিলন খান তার মেয়ের জন্য মাতৃদুগ্ধ ভাতার কার্ড চেয়েছিলেন। কিন্তু নুরুজ্জামান ফকির সেই কার্ড বাবদ তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। এরপর মিলন খান বিষয়টি চেয়ারম্যান বরাবর জানালে মেম্বার কার্ডের আবেদন জমা নেন, কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছর মিলন খানের সাথে এমন ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।
তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এটাতো আমার প্রাপ্য। আমি খেটে খাওয়া মানুষ। মাতৃদুগ্ধ ভাতার ২৮ হাজার টাকা নেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা কোথায় পাবো?
শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে— মাতৃদুগ্ধ ভাতা কার্ড এই ইউনিয়নের বাইরে অর্থাৎ অন্য ইউনিয়নেও বিক্রয় করা হয়েছে। তারা এই ইউনিয়নের লোক হিসাবে ভাতা উত্তোলন করে।
৯নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শরীফ মোস্তফা আহ্কাম বলেন, ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের শেষ নাই। দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে এবং আওয়ামী লীগ ঘরানার হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় ব্যাপক দুর্নীতি করে সম্পদ অর্জন করেছেন। রাস্তাঘাট, কালভার্ট সংস্কার ও মেরামতের নামে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে কোনো কাজ না করেই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের পরিবার কোনো রকম সুবিধা গ্রহণ করার নিয়ম না থাকলেও মেম্বার তার পরিবারের সকল সদস্যের নামে নানা ধরনের কার্ড ইস্যু করে বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছেন। যেমন তার মায়ের নামে মাতা কার্ড, ভাই ও তার ছেলের নামে ১৫ টাকা কেজি চালের কার্ড রয়েছে।
ভোট না দেয়ায় কার্ড বাতিল!
একটি দুর্ঘটনায় কোমরে আঘাত পান একই ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফরিদ খান। এরপর থেকে তিনি তেমন হাঁটাচলা করতে পারেন না। ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকিরের আগে এক নারী ইউপি সদস্য ফরিদ খানকে একটি ১৫ টাকা কেজি চালের কার্ড করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নুরুজ্জামান ফকির নির্বাচিত হওয়ার পর সেই কার্ড বাতিল করে দিয়েছেন।
ফরিদ বলেন, আমার দুই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খুব কষ্টে সংসার চালাই। এক নারী মেম্বার ১৫ টাকার কার্ড একটা দিছিল, সেটাও কাইড়া নিছে। এ বিচার কার কাছে দেব, কন?
এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ— গত নির্বাচনে তাকে ভোট না দেওয়ায় ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলন বেশ কয়েকজন হতদরিদ্র ব্যক্তির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (১৫ টাকা কেজি চালের) কার্ড বাতিল করে সেই কার্ডগুলো অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেন। কোনো কোনো ব্যক্তিকে দুইটা করে কার্ডও দিয়েছেন। কার্ড পাওয়া সেই ধনীরা কার্ডের বিপরীতে পাওয়া চাল গবাদিপশুকে খাওয়ায় বলেও জানায় এলাকাবাসী।
এছাড়া সরকারের বরাদ্দকৃত টিসিবির মালামাল দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের না দিয়ে তা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিদের কাছে বিক্রয় করে দেন ইউপি সদস্য নুরুজ্জামান ফকির নেলন। দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা টিসিবির সেসব মালামাল সেসব ব্যক্তিদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে কিনতে বাধ্য হন।
বিধবা বয়স্ক ভাতা নিয়ে নয়-ছয়
স্বামী জীবিত থাকা সত্ত্বেও টাকার বিনিময়ে অনেক নারীকে বিধবা ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন সেই ইউপি সদস্য। আরও অভিযোগ— মেম্বার নূরুজ্জামান ফকির নেলন টাকার বিনিময়ে বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য সরকারি ভাতার কার্ড দিয়ে থাকেন। চাহিদা মতো টাকা না দেওয়ায় প্রকৃত বিধবা নারীদের ভাতার কার্ড করে দেননি বলেও অভিযোগ।
এমআইকে