শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কোন জেলার কী পিঠা বিখ্যাত? 

লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

কোন জেলার কী পিঠা বিখ্যাত? 

পিঠার সঙ্গে বাঙালির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। হেমন্তের শেষের দিকে এসে যখন কৃষক তার ঘরে নতুন ধান তোলেন তখন থেকে শুরু হয় পিঠা তৈরির আয়োজন। বাতাসে যখন উত্তরের হাওয়া বইতে শুরু করে তখন শুরু হয় পিঠা উৎসব। নানা স্বাদের, নানা নকশার পিঠায় জিভের স্বাদ মেটান ছেলে থেকে বুড়ো। 

শীতের ঐতিহ্যবাহী পিঠা


বিজ্ঞাপন


সারাবছর জুড়ে বিভিন্ন উৎসবে পিঠাপুলির আয়োজন করা হলেও পিঠা খাওয়ার মৌসুম কিন্তু শীতকালই। এসময় সহজেই মেলে নতুন চাল, খেজুরের রস। আর তাতেই তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী সব পিঠা। 

pitha1

বাংলা পৌষ মাসে (ডিসেম্বর–জানুয়ারি) নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠা তৈরি হয়। এই পিঠাকে ঘিরে যে উৎসব হয়, তাকে পৌষ পার্বণ বলে। বাংলার লোকসংস্কৃতির অনুষঙ্গ পিঠা।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় পিঠা


বিজ্ঞাপন


পিঠাকে পরিচয় করিয়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় “বঙ্গীয় শব্দকোষ” বইয়ে লিখেছেন, ‘পিঠা হলো চালের গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ’। যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান, তাই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া পিঠা তৈরির অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে ময়দা, নারিকেল, খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, আখের গুড়, দুধ, তেল ইত্যাদি। কখনও কখনও সবজি কিংবা মাংসও পিঠার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

বিভিন্ন উৎসবে পিঠা 

বাংলাদেশে বিভিন্ন উৎসবে পিঠা খাওয়ার চল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পৌষসংক্রান্তি, নবান্ন, ধর্মীয় উৎসব, বিভিন্ন সামাজিক উৎসব ও রীতি-নীতি। বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, নাইওর বা ফিরানি, অষ্টমঙ্গলা, মুখে ভাত, সুন্নত-এ খৎনা, সাতোশা, নববর্ষ, সাকরাইন, অতিথি আগমন ইত্যাদি উপলক্ষে পিঠার আয়োজন করা হয়।

pitha2

একসময় বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে পাঠানো হতো বিশাল ডালা অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি ফুলপিঠা, পাক্কন পিঠা।

আরেকটি জনপ্রিয় সামাজিক অনুষ্ঠান “সাতোশা। অনেক অঞ্চলে একে “সাধ” বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পর মেয়েরা প্রথমবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাবার বাড়ি এলে বাবার বাড়ির মানুষজন উৎসবটির আয়োজন করে। গর্ভের সন্তানের বয়স যখন সাত মাস হয় তখন অনুষ্ঠানটি করা হয়। 

এসময় চন্দ্রপুলি পিঠা তৈরি করা হয়। মিহি করে কোরানো নারিকেল অথবা শিল পাটায় বাটা নারিকেলের সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে হালুয়ার মতো আঠালো পুর তৈরি করে রুটির ভেতরে পুর ভাঁজ করে অর্ধচন্দ্রাকৃতির আকার দিয়ে এই পিঠা তৈরি হয়। 

pitha3

সাতোশা এবং ঈদ-উল-ফিতরে অনেক অঞ্চলেই কাটা সেমাই পিঠা বা হাত সেমাই পিঠা তৈরি করতে দেখা যায়। খেজুরের গুড়, দুধ ও নারিকেল দিয়ে রান্না করা হয় এই সেমাই পিঠা। গ্রামাঞ্চলে কড়া রোদে শুকিয়ে পিঠা বৈয়ামে সংরক্ষণও করা হয়।

শীতের বিভিন্ন পিঠা

বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয় একটি পিঠা চিতই। শহরের অলিগলিতে শীত এলেই দেখা মেলে এই পিঠার। অনেক রকম ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়া হয়। আবার মাংসের ঝোল, কলিজা ভুনা, হাঁস ভুনার সঙ্গেও দিব্যি খাওয়া যায় এই পিঠা। খেজুরের রস বা খেজুরের রসযুক্ত দুধে ভিজিয়ে তৈরি হয় দুধ চিতই বা ভিজা পিঠা। মূলত পৌষপার্বণ ও নবান্ন উৎসবের পিঠা হিসেবে দুধ চিতই পরিচিত। 

শীতের আরেকটি জনপ্রিয় পিঠা হলো ভাপা পিঠা। কোথাও কোথাও এ পিঠা ধুপি পিঠা বা ধুকি পিঠা নামে পরিচিত। বাষ্পে সিদ্ধ করা হয় বলে এই পিঠার নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়ো দিয়ে করা ছোট ছোট পিঠার মাঝখানে দেওয়া হয় খেজুরের রসের নতুন গুড় আর নারিকেল। মোগল আমলে ঢাকার অন্যতম পিঠা ছিল ভাপা। সেই পিঠায় দেওয়া হতো ঘি, জাফরান, মালাই, খিরসা, পেস্তা বাদাম, মোরব্বা আর যশোরের খেজুরের গুড়, সুগন্ধি চাল। এই পিঠাগুলো আকারে বড়। তাই বলা হতো শাহি ভাপা পিঠা। 

pitha4

কোন এলাকার বিখ্যাত পিঠা কোনটি? 

অঞ্চল ভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পিঠা তৈরি অ খাওয়ার চল রয়েছে। কালের বিবর্তনে এখন সব মলিন হলেও জেনে রাখতে পারেন অঞ্চলভেদে বিখ্যাত পিঠাগুলোর নাম। 

ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বেশি তৈরি হয় নকশি পিঠা, পাক্কন পিঠা, ফুল পিঠা। চালের খামির তৈরি করে তা মোটা মোটা করে বেলা হয়। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তার ওপর খেজুর কাঁটা দিয়ে একটু গভীর করে আলপনা আঁকা হয়। মুগ পাক্কন বা পাকনও একধরণের নকশা করা পিঠা। তবে এর খামির তৈরিতে মুগ ডাল ব্যবহার করা হয়। 

ঢাকার বিয়েতে থাউকা বড়া নামের একটি পিঠা তৈরি হয়। অঞ্চলভেদে এটি পুয়া, মালপোয়া, ভাজা পিঠা, তেলের পিঠা ইত্যাদি নামে পরিচিত। চালের গুঁড়া আর গুড়ের তরল মিশ্রণ ডুবো তেলে ভেজে এই পিঠা তৈরি করা হয়। 

pitha5

ঢাকা ও এর আশেপাশের অন্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার তালিকায় রয়েছে পাটিসাপটা, গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছিটপিঠা, ছানার মালপোয়া, বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, দুধ পুলি, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, ঝাল পাটিসাপটা, তিল পুলি, সাবুর পিঠা, ম্যারা পিঠা, ছিটরুটি ইত্যাদি।

নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে রয়েছে খোলাজা পিঠা, ম্যারা পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, ডিমের পানতোয়া, নারিকেলের চিড়া ইত্যাদি।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বিন্নি ভাত বা মধু ভাত। এই অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি পিঠা হলো আতিক্কা পিঠা। কলা, নারিকেল, বিন্নি চাল, চিনি দিয়ে কলাপাতায় মুড়ে ভাপে এই পিঠা তৈরি হয়। আবার বিন্নি চালের গুঁড়োয় গুড় আর নারিকেল মিলে তৈরি হয় বিন্নি পুলি পিঠা। 

pitha6

শরিয়তপুর বিখ্যাত বিবিখানা পিঠার জন্য। রান্না করা মাংস, চালের গুঁড়া, পেঁয়াজ, মরিচ সব মিশিয়ে জামালপুরে তৈরি হয় রোট পিঠা। এটি সিলেট অঞ্চলেও খাওয়া হয়। 

সিলেটের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্য চুঙ্গাপুড়া পিঠা। এটি চুঙ্গা পিঠা নামেও পরিচিত। একসময় শুধু পাহাড়ি আদিবাসীদের খাবার ছিল এটি। পরে সমতলের মানুষও এই খাবার তৈরি করতে শিখে যায়। বাঁশের চুঙ্গায় বিন্নি চাল কলাপাতায় পুড়ে ভরা হয়। এরপর বাঁশ পুড়িয়ে এই পিঠা তৈরি হয়। সিলেটের আরেকটি প্রচলিত পিঠা নোনতা বা নুনগড়া পিঠা।

খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষের প্রিয় হাত সেমাই পিঠা। এ পিঠা ভাপে সেদ্ধ করে হাঁস ভুনা দিয়ে খাওয়া হয়।

pitha7

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী নাম জানা-না জানা পিঠা ছড়িয়ে আছে। অঞ্চল ভেদে পিঠার নাম পাল্টে যায়, প্রস্তুতপ্রণালিতে আসে ভিন্নতা। শীতকালে সবখানেই আয়োজন করা হয় পিঠামেলা কিংবা পিঠা উৎসবের। 

কর্মব্যস্ততা মানুষ ভুলতে শুরু করেছে ঐতিহ্য। আজকাল আয়োজন করে আর তেমন পিঠা বানানোর হয় না। তবে মা-খালা-চাচিদের স্মরণে নতুন করে পিঠাগুলো তৈরি করতে পারেন। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিন বাংলার হারতে বসা ঐতিহ্যের সঙ্গে। 

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর