মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

আইনি মারপ্যাঁচে আটকা পড়েছে আজহারের রিভিউ শুনানি?

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:০২ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেও কার্যকর করে যেতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিতর্কিত সেই ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ। এই অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আজহারুল ইসলাম ফাঁসির সাজার রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদন করেছেন। উচ্চ আদালতে এবার সুবিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা আশা করছেন, তিনি ফাঁসির দণ্ড থেকে বেকসুর খালাস পাবেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই এটিএম আজহারের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী। গত মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় দলটি। রাজধানীর পল্টনে কেন্দ্রীয়ভাবে পালিত কর্মসূচি থেকে এটিএম আজহারকে মুক্তির দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় জামায়াত। এর মধ্যেই তার রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায় আসে। দলটির নেতাকর্মীদের আশা ছিল, এটিএম আজহার জামিনে মুক্ত হবেন। তবে এদিন শুনানি না হওয়ায় অনেকটা হতাশ হন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান নিজের ফেসবুক পেইজে এটিএম আজহারের মুক্তি দাবি করে স্বেচ্ছায় কারাবরণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


এটিএম আজহারের রিভিউ আবেদনের শুনানি বৃহস্পতিবার কেন অনুষ্ঠিত হলো না? এ ব্যাপারে আইনি বিধান কী বলে? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কোনো মামলার রিভিউ আবেদনের শুনানি বছর ধরে নাকি মামলার গুরুত্ব বুঝে, নাকি আদালতের পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে- সেটি নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। আইনজ্ঞরা বলছেন, সরকার এবং আদালতের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে এটি। তারা বলছেন, মামলার গুরুত্ব এবং সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে রিভিউ আবেদনগুলোর শুনানি হয়। সে দিক বিবেচনায় আজহারুল ইসলামের ফাঁসির সাজার রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদনের বিষয়টি আদালতের তালিকায় আসা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু শুনানি হয়নি। তাহলে কি এটিএম আজহারের রিভিউ শুনানি আইনি মারপ্যাঁচে পড়েছে- এমন প্রশ্ন সামনে আসছে।

ajharul2

বৃহস্পতিবারের (২০ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের  কার্যতালিকায় রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য ধার্য ছিল। তালিকায় ৯ নম্বর আইটেম ছিল এটি। কিন্তু শুনানি হয়নি। কারণ আইটেম শুনানি করে শেষ করতে পারেননি প্রধান বিচারপতির আদালত। এ কারণে রিভিউ আবেদনের শুনানিটি আগামী বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) হবে বলে জানা গেছে।

এদিন আজহারুল ইসলামের পক্ষে আদালতে শুনানি করতে গিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তবে শেষ পর্যন্ত শুনানি না হওয়ায় তিনি ফিরে আসেন।

এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের শুনানি পিছিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন। বেঞ্চে এক বিচারপতি না থাকায় আদালত শুনানির দিন পিছিয়ে দেন।

তাহলে কী কারণে এটিএম আজহারুল ইসলামের রিভিউ আবেদনের শুনানিতে দেরি হচ্ছে- সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরশেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কোনো মামলার  রিভিউ শুনানি প্রধান বিচারপতি ও সরকারের ওপর নির্ভর করে। সরকারের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল যখন কোর্টে যান তখন কোর্ট গুরুত্ব দেন বেশি। এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেবের বিষয়টি এরকমই। বর্তমান যে সিচুয়েশন তাতে করে রিভিউ আবেদনের শুনানিটি খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়ার কথা।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সম্পাদক ও বাংলাদেশ ল'য়ার্স কাউন্সিলের সহ-সম্পাদক সাইফুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রিভিউ শুনানি যেকোনো সময় হতে পারে। এই শুনানি হতে আদালতের নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই। আদালত এবং আইনজীবীর গুরুত্ব বুঝে নির্ধারিত হয়ে থাকে বিষয়টি। মাননীয় প্রধান বিচারপতি রিভিউ শুনানির বিষয়টি দেখভাল করে থাকেন। তিনি চাইলে গুরুত্ব বুঝে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো রিভিউ শুনানির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এরকম নজির অনেক।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘আজকেও বিসিএস চাকরির প্রার্থীদের বিষয়ে একটি রিভিউ শুনানি হয়েছে। এই রিভিউটি ছিল আজহারুল ইসলামের মামলার পরের রিভিউ। কাজেই আমরা বলতে পারি, এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব তার মৃত্যুদণ্ডের রিভিউর যে আবেদন করেছিলেন সেই আবেদনের শুনানি নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে।’

রিভিউ করে এটিএম আজহারুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাবেন এমন আশার কথা জানিয়ে জামায়াতপন্থী এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা আশা করছি তিনি খালাস পাবেন। একটা মিথ্যা মামলায় তাকে সাজা দিয়ে বছরের পর বছর বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমরা রিভিউর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছি। আশা করছি এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব খালাস পাবেন। খালাস পেলে উনি কারামুক্ত হবেন। এরকম নজিরও অনেক আছে।’

ajharul3

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আমাদের জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত রায়ের মাধ্যমে। আমরাও চাচ্ছি সংক্ষিপ্ত রায়ের মাধ্যমে এটিএম আজহারুল ইসলাম কারামুক্ত হবেন। এমনও হতে পারে সকালে এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেবের রায় হয়েছে, বিকেলে তিনি মুক্ত হয়েছেন।’

আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের জুনিয়র ব্যারিস্টার হিমু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আজহারুল ইসলাম সাহেবের রিভিউ শুনানিটি বৃহস্পতিবারের তালিকায় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুনানি হয়নি। আশা করছি সামনের বৃহস্পতিবারে শুনানি হবে এবং এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব কারামুক্ত হবেন। খালাস পাবেন।’

২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় দেন। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শতশত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো নয় ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১ নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন। যদিও এটি প্রহসনের রায় বলে আখ্যায়িত করে আসছে জামায়াতে ইসলামী।

২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ১১৩ যুক্তিতে জামায়াত নেতা আজহারকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ২৩৪০ পৃষ্ঠার আপিল দাখিল করা হয়।

এআইএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


News Hub