বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

বিচারক নিয়োগ নিয়ে আইনজ্ঞদের যত মত

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

বিচারক নিয়োগ নিয়ে আইনজ্ঞদের যত মত
ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কাজ অব্যাহত রেখেছে। এর অংশ হিসেবে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের একটি নীতিমালা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে সেটা উল্লেখ থাকবে আইনে। এছাড়া বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে একটা বয়সের মাপকাঠিও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এটা নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে নানা মত।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে সততা, যোগ্যতা ও দক্ষতাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। সে ক্ষেত্রে বয়স বিবেচনাকে মুখ্য হিসেবে না দেখার দাবি জানিয়েছেন কোনো কোনো আইনজীবী। একজন বিচারকের যোগ্যতা অর্জনে বয়সকে গুরুত্ব না দিয়ে তার কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পরামর্শ তাদের। কারণ, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। আইনের সূক্ষ্ম ও চুলচেরা বিশ্লেষণের যোগ্যতা না থাকলে নির্দোষ আসামিও অনেক সময় ফাঁসির মঞ্চে যেতে হয়। আবার দাগি আসামিও অনেক সময় পার পেয়ে যান। বিচারিক আদালতের রায় সূক্ষাতিসূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই না করে রায় দিলে ক্ষতির কারণ হয় অনেকের। এজন্য আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিচারকের যোগ্যতাই মুখ্য হওয়া উচিত। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, বিচারক হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি বয়স নির্ধারণ থাকা জরুরি। সেক্ষেত্রে একজন বিচারকের বয়স ৪০ বা ৪৫ বছর হলেও সমস্যা নেই।


বিজ্ঞাপন


ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি খসড়া নীতিমালা করেছে আইন মন্ত্রণালয়। সেই খসড়ায় ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ নামে একটি কাউন্সিল রাখা হয়েছে। যার চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতি। সেই কাউন্সিলের কাজ হবে আইনজীবী বা নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাই করে হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা।

আরও পড়ুন

সেই খায়রুল হক এখন কোথায়?

আওয়ামী লীগের ‘সুবিধাভোগী’ আইনজীবীরা আদালতে অনুপস্থিত কেন?

খসড়ায় বলা হয়েছে, ৪৫ বছর এর নিম্নে বয়স এমন কেউ বিচারক হতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিকত্ব, ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিতরাও বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাবেন না। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনের কোনো নির্দিষ্ট শাখায় প্রার্থীর বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা, প্রজ্ঞা, সততা, সুনাম, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ আবশ্যিকভাবে বিবেচনার কথা খসড়ায় বলা হয়েছে। বিচারিক আদেশ ও সিদ্ধান্তের গুণগত মানের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৪’ খসড়ার ওপর মতবিনিময় সভায় এ বিষয়ে বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বিচার বিভাগের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, উচ্চ আদালতে এমন বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন, যিনি নিম্ন আদালতে বিচারক হওয়ার পরীক্ষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। এমন বিচারকও আছেন, যিনি কোনোদিন কোর্টে প্র্যাকটিস করেননি। ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে গেছে।


বিজ্ঞাপন


আইন উপদেষ্টা বলেন, সবাই বলেছেন উচ্চ আদালতের নিয়োগ ভালো হতে হবে। বর্তমান সিস্টেম কাজ করছে না। শুধু উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনাচার হয় না, আপিল বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে, বেঞ্চ গঠনের এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনাচার হয়।

আসিফ নজরুল বলেন, আমরা যদি ভালো আইন করে ৩০-৪০ জন বিচারক নিয়োগ দিতে পারি, ওনারা ২০-৩০ বছর দেশকে সার্ভ করবেন। উচ্চ আদালত নামক প্রতিষ্ঠানটা নষ্ট করলে দেশের যেকোনো সরকার এসে সব ধরনের মানবাধিকার হরণের অবাধ সুযোগ পেয়ে যাবে। গত ১৫ বছর এই কাজটা করা হয়েছে। উচ্চ আদালত মানবাধিকার হরণ, মানুষকে নির্যাতন করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। জঘন্য সব ঘটনা ঘটেছে।

বিচারক কেমন হবেন, কী বলছেন আইনজ্ঞরা

বিচারক নিয়োগে বয়স মুখ্য বিষয় না, যোগ্যতাই আসল- এমন মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা, মেধা ও কাজের পারদর্শিতা। একজন ব্যক্তি কম বয়সে আইনজীবী হওয়ার পরে যদি তিনি বেশ কিছু মামলা পরিচালনা করে থাকেন অথবা তার সিনিয়রের কাছ থেকে যথেষ্ট শিখে থাকেন, যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন, পরিবেশটা বোঝেন, এমন লোককে এই পদে নিয়োগ দিতে কোনো সমস্যা নেই।

justic_2
নতুন নিয়োগ পাওয়া ২৩ বিচারপতি সম্প্রতি বঙ্গভবনে যান। ছবি: সংগৃহীত

অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতাকেই মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরা হয়। ভারত-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশগুলোতে এটি ফলো করা হয়।

এই আইনজ্ঞ আরও বলেন, অনেকেই ২৪ বছর বয়সে আইনজীবী হয়েছেন। অনেক মামলা পরিচালনা করেছেন। সিনিয়রের কাছে অনেক কিছু শিখেছেন। কিন্তু আবার কেউ কেউ দেরিতে আইনজীবী হওয়ায় হয়তো অনেক কিছু শিখতে পারেননি। সেক্ষেত্রে জানাশোনার ঘাটতি রয়ে যায়। এজন্য আমি বলব, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স মূল বিষয় না, যোগ্যতাই হচ্ছে আসল।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের সময় আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকা উচিত। নিম্ন আদালত থেকে যারা নিয়োগ পান তারা অনেক সময় কৃপণ হন। তবে ব্যতিক্রমও আছেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের সাজা দেওয়ার মানসিকতা বেশি, যেটা ফৌজদারি আপিল শুনানির সময় দেখেছি। শুধু দশ বছর আইন পেশায় থাকলেই হবে না, অভিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রাধান্য দিতে হবে। আর বয়সের সীমা ৪৫ থাকা যুক্তিযুক্ত। নিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ কোটা রাখা উচিত।

আরও পড়ুন

বছরজুড়ে আলোচনায় উচ্চ আদালত, ‘নজিরবিহীন’ ঘটনার সাক্ষী

‘আনিসুলের বান্ধবী’ তৌফিকার অপকর্মে তটস্থ ছিল আইনাঙ্গন!

অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামান বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী এই ধরনের আইন করার সুযোগ আছে কি না? আমার মনে হয় আইনে যে অতিরিক্ত যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তাহলে তা সংবিধানের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৯৫(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগের কথা বলা হয়েছে খুবই ভালো। সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতির পাশাপাশি বার কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যানকে রাখা হলে এটা আরও সমৃদ্ধ হবে।

একজন সংসদ সদস্য নির্বাচনে সংবিধানে যেমন বয়সের লিমিট আছে, তেমনি বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বয়সের ব্যাপারটি সেটেল্ট হওয়া দরকার বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এখলাছ উদ্দিন ভুঁইয়া। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে বয়সের একটা ভিত্তি রয়েছে। কারণ অল্প বয়সী আর প্রাপ্তবয়স্ক বা দীর্ঘদিন ধরে এই অঙ্গনে কাজ করছেন এমন লোকের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য থাকা উচিত।

এই আইনজীবী বলেন, যাদের ভালো জানা আছে তাদের বিচারক নিয়োগ দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। সংবিধানে যেমন নিয়ম রয়েছে, আমাদের দেশের যারা সংসদ সদস্য হবেন, তাদের বয়সের একটা লিমিট রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এটি থাকা উচিত। কারণ সুপ্রিম কোর্টের একটা পরিবেশ রয়েছে, সেটিরও কৃষ্টি কালচার রয়েছে। সেখানে অনেক সিনিয়র আইনজীবী রয়েছেন, বিচারও করেছেন। এই যে একটা পরিবেশ, পুরো পরিবেশ যদি আমি না বুঝি বা ভালো বিচার করতে না পারি, সে ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যক্তিরা সমান হবেন না।

এখলাছ উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, আপনারা জানেন, সুপ্রিম কোর্টের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে, যেখানে বিচারকদের সিদ্ধান্তের ওপর কিন্তু আসামির মরা-বাঁচা। আবার রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিন্তু নির্ভর করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের যোগ্যতার ওপর। সেক্ষেত্রে বিচারকের যে একটা ম্যাচুরিটি থাকা দরকার।

এআইএম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর