ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারাঙ্গনের অঘোষিত ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কথিত বান্ধবী তৌফিকা করিম। আনিসুল হকের ছোঁয়ায় অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিচারিক আদালতেও ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। গড়ে তুলেছিলেন বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব সিন্ডিকেট।
গুরুত্বপূর্ণ মামলায় প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো রায় ও জামিন করিয়েছেন তৌফিকা করিম। বিনিময়ে লুটে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। টাকার বিনিময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার দুর্ধর্ষ আসামিদেরও জামিন করিয়ে দিতেন এই ক্ষমতাধর নারী। অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা। তৌফিকার এসব কর্মকাণ্ডে বিচারের বাণী যেন নীরবেই কেঁদেছে এক দশকের বেশি সময়।
বিজ্ঞাপন
অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম পরিচয় দিতেন একাধারে আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও ব্যাংকার হিসেবে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত বেসরকারি টেলিভিশন দেশ টিভির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনী হলফনামার তথ্যমতে তিনটি পুকুর, কৃষিজমির ফসল ও মাছের চাষাবাদ ছিল আয়ের প্রধান উৎস। ২০১৪ সালে প্রথমবার মন্ত্রী হওয়ার পর তার সম্পদ হু হু করে বাড়তে থাকে। অভিযোগ আছে, ঘুষের টাকা গুনতে বাসায় বসিয়েছিলেন টাকা গোনার মেশিন।
৪০০ কোটি টাকা জামানত এবং ২০০ কোটি টাকা চলতি মূলধন দিয়ে সিটিজেন ব্যাংকের মালিক হন আনিসুল হক। তার মা এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান করা হয় দুর্নীতির চরম শিখরে পৌঁছানো আলোচিত-সমালোচিত তৌফিকা করিমকে। কথিত এই বান্ধবীই ছিলেন আনিসুল হকের চালিকাশক্তি। তিনি যা বলতেন তাই করতেন আনিসুল হক।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগ রয়েছে, বড় বড় দুর্নীতি মামলার আসামিদের জামিনের গ্যারান্টি দিতেন তৌফিকা। বড় বড় ক্রিমিনালদের হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর নিম্ন আদালত থেকে জামিন করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও নিতেন। জানা যায়, ফার্মার্স ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকারী রাশেদুল হক চিশতীকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট জামিন দেননি। অথচ ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালতের বিচারককে বাধ্য করে জামিন করান আনিসুল হকের এই বান্ধবী। বহুল আলোচিত হলমার্কস গ্রুপের দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত জামিন পাননি আসামি জেসমিন। বিপুল টাকা নিয়ে নিম্ন আদালতে চাপ সৃষ্টি করে জামিন করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তৌফিকার বিরুদ্ধে।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরপর গ্রেফতার হন আনিসুল হক। ৫ আগস্টের পর থেকে আত্মগোপনে তৌফিকা করিমও। প্রভাবশালী এই নারী ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে কানাডায় ছেলের কাছে চলে গেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেখানেও তার বিপুল সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
তৌফিকার দুর্নীতি ও অনিয়মে বিরক্ত ছিলেন খোদ আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরাও। মাঠে দুর্দিনে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করা আইনজীবীরা আনিসুল হকের কাছে যেতে পারতেন না তৌফিকার যন্ত্রণায়। যদিও তৌফিকা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আইনজীবী হিসেবেও কোর্টে মামলার রেকর্ড কম তার। চেম্বারে বসেই উকালিত করতেন তিনি। এই আইনজীবী আনিসুল হকের বাবা বিখ্যাত আইনজীবী সিরাজুল হকের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন। তবে তৌফিকা করিমের বাবা এম এ করিম আওয়ামী লীগের কুমিল্লা ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ জেলা ইউনিটের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা মাঠে রাজনীতি করেছি। ছাত্রলীগ করেছি, যুবলীগ করেছি। আমরা আইনজীবী হিসেবে সনদ পাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষে আদালত অঙ্গনে কাজ করছি। কিন্তু আইনাঙ্গনে আমাদের অবমূল্যায়ন করেছেন আনিসুল হকের বান্ধবী তৌফিকা করিম। তার যন্ত্রণায় আমরা আনিসুল হকের কাছে ঘেষতেও পারতাম না। আমাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। আইন মন্ত্রণালয়ের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তৌফিকা করিম। তার যন্ত্রণায় আমরা তটস্থ থাকতাম।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের দুইজন সদস্য এবং সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী। আওয়ামী রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছি বলেই আমাদের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। আমরা শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে সর্বোচ্চ আইনি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শুধু আইনজীবী নয়, আওয়ামী লীগের জন্য ছাত্রজীবন থেকেই ডেডিগেটেট ছিলাম। কিন্তু সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী তৌফিকা করিমের জন্য অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছি। তৌফিকা কোনোদিন আওয়ামী লীগের মাঠের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আওয়ামীপন্থী আইনজীবী হিসেবে কোনো দিন মাঠে ময়দানে কাজও করেননি। কিন্তু আওয়ামী সরকারের আমলে বড় বড় সুবিধাগুলো বাগিয়ে নিয়েছেন।
তৌফিকার বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বারবার চেষ্টা করেও সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
সাবেক আইনমন্ত্রীর ‘বান্ধবী ও ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার’
এদিকে তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে সিআইডি। সংস্থাটি এই খবর জানিয়ে গণমাধ্যমে যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সেখানে তৌফিকা করিমকে বর্ণনা করা হয়েছে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ‘বান্ধবী ও ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার’ হিসেবে।
সিআইডি বলছে, বিভিন্ন উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী ও ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত তৌফিকা করিম এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি।
তৌফিকা করিম আইন পেশার সূত্রে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বলে সিআইডির ভাষ্য। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাবেক এই মন্ত্রীর প্রত্যক্ষ মদদ ও প্রশ্রয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সিন্ডিকেট ও লুটপাটের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে।
সিআইডি বলছে, ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীর অধস্তন আদালতে খাতা পরিবর্তন, জালিয়াতি, পরীক্ষা না দিয়েও চাকরি প্রদান, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা গ্রহণকরে তাদের জামিনসহ মামলার রায় পরিবর্তন করে দিতেন তৌফিকা করিম।
তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালে ঢাকার দায়রা জজ আদালত ও মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অনিয়মের মাধ্যমে সাবেক মন্ত্রীর এলাকা আখাউড়া-কসবার ১৮ জন গাড়িচালক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
তৌফিকা করিম আনিসুল হকের মালিকানাধীন সিটিজেন চার্টার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন।
সিআইডি বলছে, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের অবৈধ সম্পদ দিয়ে তৌফিকা করিম কানাডা, দুবাই এবং মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম হিসেবে কয়েকটি বাড়ি করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে তারা। গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ২৬ জুলাই তৌফিকা দেশ ছেড়ে কানাডা চলে যান বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
তৌফিকা করিম এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সরকার পতনের পর গত ১৪ অগাস্ট বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আনিসুল হকের সঙ্গে তৌফিকা করিমের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করে।
এআইএম/জেবি