আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে এই দলের নাম ভাঙিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এর মধ্যে আইনজীবীরা ছিলেন শীর্ষে। আদালত অঙ্গনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের দাপট ছিল একচেটিয়া। নানা অপরাধের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন তারা। জাতীয় নির্বাচনের আদলে ভুয়া ভোট কিংবা ক্ষমতার জোরে আইনজীবী সমিতিগুলোও দখলে নিয়েছিলেন আওয়ামীপন্থীরা।
তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর উধাও হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের সুবিধা নেওয়া আইনজীবীরাও। ‘কঠিন আওয়ামী লীগার’ হিসেবে পরিচিত বেশির ভাগ আইনজীবীই অনুপস্থিত উচ্চ আদালতে। নিম্ন আদালতেও একই অবস্থা। দেশের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও দেখা মিলছে না তাদের। এমনকি গ্রেফতার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের আইনি সেবা পাচ্ছেন না। নিজ দলেই প্রশ্ন উঠছে, এত বছর সুবিধা নেওয়া দলীয় আইনজীবীরা এখন কোথায়? তারা কেন প্রকাশ্যে আসছেন না?
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে হতাহতের ঘটনায় ইতোমধ্যে অনেক আইনজীবী নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। যারা আসামি হননি তারাও ভয় পাচ্ছেন। অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় কে কখন কোন মামলায় গ্রেফতার হন, সে আতঙ্ক তাড়া করছে তাদের। এজন্য গা ঢাকা দিয়ে আছেন তারা। এছাড়া প্রকাশ্যে এলে জনরোষ পতিত হতে পারে- সেই ভয়ও আছে কারও কারও।
আওয়ামী লীগপন্থী একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সন্তোষজনক মনে না হওয়ায় তারা আদালতমুখী হচ্ছেন না। অনেকের মনে শঙ্কা, দায়েরকৃত এসব হত্যা মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হতে পারে। আবার আদালতে এলে হামলা হতে পারে- এমন ভয়ও আছে অনেকের। সেজন্য এক ধরনের শঙ্কা থেকেই আইনজীবী নেতারা আত্মগোপনে আছেন।
গা ঢাকা দেওয়া আইনজীবী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের আমলে সব শেষ অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালনকারী আবু মোহাম্মাদ আমিন উদ্দিন। এছাড়া আছেন আইনাঙ্গনের প্রভাবশালী শেখ পরিবারের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে নূর পরশের স্ত্রী নাহিদ সুলতানা যূথী, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, শ ম রেজাউল করিম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সমিতির সাবেক সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক ও আবদুন নূর দুলাল, সাবেক এমপি সানজীদা খানম, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পিপি আব্দুল্লাহ আবু, বার কাউন্সিলের সাবেক নেতা মোখলেসুর রহমান বাদল, মোশাররফ হোসেন কাজল প্রমুখ।
বিজ্ঞাপন
এদিকে মামলার আসামি হয়ে কারাগারে আছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মেহেদী হাছান চৌধুরী, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন প্রমুখ।
গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন দেড় হাজারের অধিক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আর ২৩ হাজারের অধিক মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন হাসপাতালে। এসব ঘটনায় জনরোষ এখনো পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। প্রকাশ্যে এলে ‘মব জাস্টিসের’ শিকার হতে পারেন- এমন শঙ্কা থেকেই প্রকাশ্যে আসছেন না আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী আইনজীবীরা।
আরও পড়ুন
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক দুইজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নাম প্রকাশ না করে ঢাকা মেইলকে বলেন, উনারা অনেক মামলা করেছেন। অনেক ব্যস্ত আইনজীবী ছিলেন। আমাদের গাইড করেছেন। কিন্তু বর্তমান বিভিন্ন কারণেই তারা আদালতে আসতে পারছেন না।
আবার কেউ কেউ বয়স্ক হওয়ায় শারীরিক অক্ষমতার কারণে বিশ্রাম নিচ্ছেন। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে কোর্ট কাচারিতে মামলার সংখ্যাও কম, তাই তারা কোর্টে আসছেন না বলে জানা গেছে। অনেকের বয়সই ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে। তারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই কম আসতেন আদালতে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন অর্থবিত্ত আছে, পাশাপাশি শারীরিক কথা বিবেচনা করেও আদালতে আসতে অনীহা জানাচ্ছেন।
তবে সিনিয়রদের একটি অংশ আদালতে আসছেন। তাদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মো. অজিউল্লাহ, সাবেক সহসভাপতি জেসমিন সুলতানা, সুপ্রিম কোর্ট বারের আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে সভাপতি পদে ভোটে অংশ নেওয়া আবু সাইদ সাগর সাগর, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, সুপ্রিম কোর্ট বারের বার কাউন্সিলের সাবেক নেতা সাঈদ আহমেদ রাজাসহ অনেকেই রয়েছেন।
সাধারণ ও দল নিরপেক্ষ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির বিগত তিনটি নির্বাচন করা হয়েছে একতরফাভাবে। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করেননি তারা। আওয়ামীপন্থী শীর্ষ আইনজীবী নেতাদের ইন্ধনে এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার শুরুতেও বারের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ছিল। কিন্তু সেই পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে ক্ষমতার শেষের দিকে এসে। আইনজীবীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী মতাদর্শের আইনজীবী প্যানেলের প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে পুলিশ প্রহরায় একতরফা ভোট করেছে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা।
এমনকি এ ধরনের ভোটের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা ও মারধরের শিকার হয়েছেন অনেকেই। বাদ পড়েননি সাংবাদিকরাও। ফলে ওই তিনটি নির্বাচন আয়োজন নিয়েও আওয়ামীপন্থী আইনজীবী নেতাদের ওপর এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ আইনজীবীদের। ফলে আওয়ামীপন্থী শীর্ষ আইনজীবী নেতারা আদালতমুখী হলে তাদের ওপর হামলা করতে পারে- এমন ভয়ও কাজ করছে অনেকের মনে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা কোর্টে আসতে কাউকে বাধা দেব না। তারা ভয় করে কোর্টে আসেন না। কারণ তারা ছিলেন স্বৈরাচারের সহযোগী। তারা ভোট চুরি করেছেন। ভোট চুরি করে তারা এখন চোর। চোর বাইরে যাওয়ার আগে চিন্তা করে কেউ আমাকে ধরবে কি না। তারা অন্যায় করেছেন।’
পিপি বলেন, ‘২০১৬ সালের পর থেকে তারা ঢাকা বারের ভোটে কারচুপি করে নিজেদের মতো করে নেতা বানিয়েছেন। তারা ঢাকা বারের ভোটের পরিবেশটা নষ্ট করেছেন। আইনজীবীদের মারধর করেছেন। ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র আইনজীবী কামরুল ইসলাম প্রকাশ্যে ভোটের দিন থেকে তার জুনিয়রকে সেক্রেটারি বাসাতে ব্যালেট পেপার ছিনতাই করতে সহযোগিতা করেছেন।’
এই আইনজীবী নেতা আরও বলেন, ‘আমি কামরুল ইসলামকে বার বার বলেছি, আপনি এগুলো কেন করছেন। তারা সে সময় আমাদের কথা শোনেনি। সাধারণ আইনজীবীদের জমানো বারের কোটি কোটি টাকা তসরুপ করেছেন। আত্মসাৎ করেছেন। তাদের ওপর মানুষের আস্থা নেই। এজন্য তারা কোর্টে আসেন না। কোর্টে এলে মানুষ তাদের মূল্যায়ন করে না। মক্কেল নেই। তারপরেও আওয়ামী লীগের দুই-একজন সিনিয়র আইনজীবী কোর্টে আসেন। মামলা করে চলে যান। আমরা কাউকে বাধা দিচ্ছি না। ঢাকা বারের ভোট এখন থেকে স্বচ্ছ হবে। কোনো কারচুপি হবে না। আমরা স্বৈরাচারের কালচার বদলাব।’
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী কামরুল ইসলাম সজল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অপরাধবোধ থেকে তারা হয়ত কোর্টে আসেন না। আমরা কোর্টে আসতে কাউকে বাধা দিচ্ছি না। উনারা কেন আসেন না সে ব্যাখাটা উনারাই ভালো দিতে পারবেন। তবে আমাদের ওপর, সাধারণ আইনজীবীদের ওপর উনারা (আওয়ামী লীগ সমর্থিত) আইনজীবীরা অনেক জুলুম করেছেন। অপরাধ করেছেন। অপরাধবোধ থেকেই তারা হয়ত কোর্টে আসেন না। আবার তাদের অনেকেই কোর্টে আসেন। মামলা করেন। এটা ম্যান টু ম্যান ভেরি করে।’
সামনে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট কেমন হবে, এক দলকেন্দ্রিক নাকি সবার অংশগ্রহণমূলক? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই নির্বাচন করতে চাই। এতে করে আইনজীবীরা যাদেরকে পছন্দ করবে তারাই নির্বাচিত হবেন।’
এআইএম/জেবি