দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত-সমালোচিত নাম বিচারপতি খায়রুল হক। জনরোষে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসক হয়ে ওঠার পেছনে যারা মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন, তাদের অন্যতম এই বিচারপতি। তার কলমের খোঁচাতেই বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এতে পরপর তিনটি ‘আজগুবি’ ও ‘ভুয়া’ নির্বাচনের সুযোগ পান শেখ হাসিনা।
আইনাঙ্গনে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া খায়রুল হক ‘বিশেষ পুরস্কার’ হিসেবে পান আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ। তিন বছরের জন্য পদটিতে নিয়োগ পেলেও আস্থাভাজন এই বিচারপতিকে শেখ হাসিনা টানা ১০ বছর এই পদে টিকিয়ে রাখেন। তবে হাসিনার শাসনের পতনের পরপর আইনাঙ্গনে অবসান ঘটে খায়রুল হকের অধ্যায়েরও। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরপর তিনিও পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে অনেকটা লাপাত্তা খায়রুল হক। তিনি কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে জানতে নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে তার অনেক ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে কেউই তার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেননি। যদিও একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, তিনি পুরান ঢাকায় মেয়ের বাসায় অবস্থান করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এবিএম খায়রুল হকের এক ঘনিষ্ঠজন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। বর্তমানে তিনি পুরান ঢাকায় মেয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে কারও সঙ্গে তেমন দেখা করেন না।’
তার অবস্থান নিশ্চিতে আইন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কমকর্তা ড. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের আগে এবিএম খায়রুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর উনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন জানি না।’
বিজ্ঞাপন
খায়রুল হকের ইচ্ছায় বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার
দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান খায়রুল হক। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তার নিয়োগ কার্যকর হয়। পরের বছরের ১৭ মে তিনি অবসরে যান।
২০১৩ সালের ২৩ জুলাই খায়রুল হককে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়। এক দশকের বেশি সময় দায়িত্ব পালনের পর গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন তিনি। ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া ওই রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত ছিল না। বরং এটি ছিল গভীরভাবে (অনেকটা সমান সমানভাবে) বিভক্ত রায়। রায় দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন এবিএম খায়রুল হক।
রায় দেওয়া ছয় বিচারপতির মধ্যে তিনজন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দিলেও তিনজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি ইমান আলীর রায়টি একটু ভিন্ন ধাঁচের হলেও তার রায় স্পষ্টত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। একেবারে সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায় বাতিলের পক্ষে চার-তিনে মেজোরিটি হয়।
এছাড়া আপিল বিভাগে থাকার সময় ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন খায়রুল হক। হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছিলেন আলোচিত এই বিচারপতি। এছাড়া তিনি ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ উল্লেখযোগ্য মামলায় রায় দেন।
মামলার আসামি খায়রুল হক
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলাও হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন মামলাটি করেন।
এছাড়া খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়। ১৩ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেওয়ার ঘটনায় মামলাটি করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের অভিযোগে বিচারপতি খায়রুল হকের বিচার দাবি করে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। শেখ হাসিনার ‘অবৈধ’ শাসনের জন্য তারা খায়রুল হককে দায়ী করেন। ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এআইএম/এমআর/জেবি