মহামারি করোনাভাইসের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখন কালো কোট পরে ভাড়ায় বাইক চালানোর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে আলোচনায় এসেছিলেন আইনজীবী মাসুদ রানা। সেই পোস্টে প্রধান বিচারপতির কাছে আদালত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। তখন মাসুদ রানাকে নিয়ে আইনাঙ্গনে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। বিষয়টি গড়িয়েছিল উচ্চ আদালতেও। তাকে সতর্ক করে হাইকোর্ট বলেছিলেন, এসব করে আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করবেন না।
তখন ফেসবুকে আবেগঘন একটি পোস্ট দিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা। ‘মাননীয় প্রধান বিচারপতি! আপনার কোর্ট অফিসার এখন বাইক রাইডার’ এ শিরোনামে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আইন পেশা লকডাউনে সম্পূর্ণ বন্ধ। অন্য সময় সীমিত পরিসরে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু ছিল। কিন্তু এখন লকডাউন স্থগিত হলেও কোর্ট বন্ধ। সব পেশার মানুষ কাজ করতে পারছেন, শুধু আইনজীবীরাই কর্মহীন।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও লিখেন, ‘দীর্ঘ এক বছর চার মাস উপার্জনহীন থাকলেও বাড়ি ভাড়া, চেম্বার ভাড়া, বার কাউন্সিল, বার অ্যাসোসিয়েশনসহ জীবন-যাপন ব্যয় থেমে নেই। কোর্ট অফিসারদের (আইনজীবী) চরম দুর্দিন চলছে। আইনজীবীদের চিফ অথোরিটি মাননীয় প্রধান বিচারপতি, কিন্তু তাকে কিছু বলা যাবে না। আদালত অবমাননার অভিযোগে সনদ চলে যায়। অনেকেই আপদকালীন ভিন্ন পেশা গ্রহণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠরা কোর্ট খোলার আশায় আছেন। কিন্তু আমি অতি সাধারণ, তাই এত কিছু না ভেবে কর্ম এবং উপার্জনের লক্ষ্যে আপদকালীন এ বাইক রাইডিং পেশা শুরু করলাম। সবার নিকট দোয়া চাই। সবাই ভাল থাকবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।’
আদালত চালু হলে মাসুদ রানা দুটি মামলায় দুই আসামির জামিনের আবেদন করেছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে। মামলা দুটি শুনানি করতে গেলে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান তার বাইক চালানোর প্রসঙ্গ তোলেন। তখন আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি তাকে দেখেন বলেন, ‘মিস্টার মাসুদ আপনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন উবার চালিয়ে। এগুলো করবেন না।’
বিজ্ঞাপন
আলোচিত সেই মাসুদ রানা এখন আইনাঙ্গনে পেয়েছেন বড় দায়িত্ব। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে আইন কর্মকর্তা বা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই পদটি পাওয়ায় তিনি বেশ খুশি। এর মাধ্যমে তিনি সেবা করতে চান দেশবাসীর।
সম্প্রতি মাসুদ রানার সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা মেইলের। আলাপকালে তিনি বলেন, আমি এখন গর্ববোধ করি দেশ থেকে স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ হচ্ছে। সেই কাজে আমরাও সহযোগিতা করছি। পাশাপাশি বিচার বিভাগকে সঠিকভাবে চালাতে কাজ করছি। সাধারণ মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয় সে লক্ষ্যে আমি কাজ করছি।
মাসুদ রানা বলেন, আপনারা জানেন, ২০০৯ সাল থেকে দেশে অন্যায় অবিচার চলছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরিক হয়ে আমি অনেক মামলার আসামি হয়েছি। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। দেশের মানুষও কষ্টে ছিল। আমি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক সিনিয়র নেতার জন্য আইনি লড়াই করেছি।
বিএনপিপন্থী এই আইনজীবী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রয়াত ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ স্যারের মামলায় কাজ করেছি। বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলায় আইনি লড়াই করেছি। আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় বিভিন্ন মামলার আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছি। এখন দিন পরিবর্তন হয়েছে। অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে ২০২৪ সালে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে, স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। আইনজীবী হিসেবে আমি এখন রাষ্ট্রকে আইন সেবা দিচ্ছি।
করোনাকালের স্মৃতিচারণ করে আলোচিত এই আইনজীবী বলেন, করোনাকালে সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোর্ট-কাচারি বন্ধ ছিল। সে সময় আইনজীবী মক্কেল অনেকেই কষ্ট করেছেন। দিনের পর দিন ঘুরেছেন, কিন্তু আদালত মামলা শোনেননি। অনেক আসামি কারাগারে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। তাদের পক্ষে আইনি সেবা দিতে প্রস্তুত ছিল না বিচার বিভাগ। সব কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নামমাত্র ২/১টি কোর্ট খোলা ছিল। জামিন করানো যেত না। মানুষ কষ্ট করত। বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তিতে থাকত। আইনজীবীরাও মামলা করতে পারতেন না। তাদের আয় রোজগার কমে গিয়েছিল। তাদের চেম্বার অফিস পরিবার পরিজন চালাতে অনেক কষ্ট হতো।
মাসুদ রানা বলেন, ২০২০-২১ সালের করোনাকালে মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমি প্রতীকী আন্দোলন করেছি। কোর্ট-কাচারি খুলে দেওয়ার জন্য আমি দাবি করেছিলাম। মানুষের আয়-রোজগার, আইনজীবীদের আয়-রোজগার বাড়াতে কোর্ট খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলাম। খুলে না দেওয়ার কারণে আমার অনেক আইনজীবী বন্ধু কষ্টে দিনানিপাত করেছেন। আমি প্রতিবাদস্বরূপ রাস্তায় বাইক নিয়ে নেমেছিলাম। পাঠাও চালিয়েছি। অভিনব প্রতিবাদ করেছি।
এআইএম/জেবি