বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

ডেঙ্গুসহ সব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ‘এক দেশ এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ জরুরি

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

ডেঙ্গুসহ সব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ‘এক দেশ এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ জরুরি

শীতের শুরুতেও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত রোগটি রাজধানী ঢাকার সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়েছে সারাদেশে। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা (২৯ নভেম্বর পর্যন্ত) ২৫০ জনে দাঁড়িয়েছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬ হাজার ৯৩২ জন।

এই অবস্থায় সব স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে ‘এক দেশ এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা জরুরি বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ। ঢাকা মেইলের সঙ্গে সাম্প্রতিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ে কথা বলেছেন প্রখ্যাত এই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ।


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: চলতি নভেম্বরে ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক মৃত্যুর কারণ কী?

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ: অক্টোবরে যারা আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের অনেকেই নভেম্বরে এসে ডেঙ্গুর জটিল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। তাদের কেউ কেউ হাসপাতালে এমনকি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি ছিলেন। অনেকে হয়তো লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তাদের অনেকে এখন মারা যাচ্ছেন। এটিকে পুঞ্জীভূত মৃত্যু বলা হয়। এর মানে তখন যারা যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের মৃত্যুগুলো নভেম্বরের প্রথমে ঘটেছে। যেমন অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের শুরুর দিকে আক্রান্তের সংখ্যাটি এখানের মৃত্যু নির্ধারণ করছে। যদি এখন আক্রান্ত কম হয়, তাহলে সামনে মৃত্যু কম হবে। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসবে। কারণ যারা ভর্তি আছেন, মারা যাচ্ছেন তাদের পালা শেষ হলে তো আর মৃত্যু হওয়ার সুযোগ নেই। বিপরীতে এখন আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যু বেশি হবে।

আরও পড়ুন: ‘বেসামাল’ ডেঙ্গু: দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ছে মৃত্যু

আমরা যদি ধরে নিই যে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর শতকরা দশমিক ৫ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে, তাহলে এখন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওই আনুপাতিক হারে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। হাসপাতাল থেকে একটি তথ্য নেওয়া যেতে পারে, হাসপাতালে ভর্তির গড়ে কতদিন পরে ডেঙ্গু রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে। যেমন: করোনার ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার ১৫-২০ দিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হতো। এখানে এমন একটি সংখ্যা পেলে আগামী দিনে ঠিক কতগুলো মৃত্যু এড়ানো যাবে না তা নির্ণয় করা যাবে।


বিজ্ঞাপন


dengue3

ঢাকা মেইল: সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। সংক্রমণের গতিবিধিকে কীভাবে দেখেন?

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ: ঢাকার বাইরে আক্রান্তের বিষয়টি শঙ্কার। এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের যে ঘটনাটি ঘটল, আমরা একে মহামারি বলতে পারি। কারণ গত পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে। এই মহামারি অবশ্যই আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু চিন্তার বিষয়ে এই যে, সামনের দিনগুলোতে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। এটি যদি ব্যাখ্যা করি তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু চিকিৎসার অন্তরায় অতিরিক্ত পরীক্ষা ব্যয়

এ বছর ডেঙ্গু ঢাকা ছাড়াও প্রায় শতভাগ জেলায় ছড়িয়েছে। এমনকি তা উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। ৫০০টি উপজেলা খোঁজ নিলে দেখা যাবে তার একটা বড়সংখ্যক উপজেলায় তা ছড়িয়েছে।  প্রথমবার ডেঙ্গু হলে তা মৃদু ডেঙ্গু হতে পারে। ফলে যে লোকগুলো এবার আক্রান্ত হলো, পরের বার যদি তারা আবার আক্রান্ত হয় তাহলে তা মারাত্মক হবে। অর্থাৎ এতদিন দুই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ সীমাবন্ধ ছিল। এখন এটি ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। সারাদেশের মানুষ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। আমরা দুই কোটি মানুষের ডেঙ্গু প্রতিরোধ, মৃত্যুরোধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা করতে হিমশিম খাচ্ছি। তাহলে ১৭ কোটি মানুষের এতে মৃত্যু রোধ ও ব্যবস্থাপনা কী করে করবো? এটিই আমাকে বেশি শঙ্কিত করে দিচ্ছে।

ঢাকা মেইল: ঢাকার বাইরে রোগীদের সেবা পাওয়া কতটা সুযোগ রয়েছে?

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ:  ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার যতটা সুযোগ ও ব্যবস্থাপনা রয়েছে, ঢাকার বাইরে তা নেই। সেখানে চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা কম, পরীক্ষার সুযোগ সীমিত এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার অভিজ্ঞতাতেও ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকার বাইরে আক্রান্তদের মৃত্যুর ঝুঁকি ঢাকায় যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের থেকে বেশি। ফলে ভর্তি হওয়া রোগীদের মৃত্যুও বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণেই ‘ডেঙ্গুর হটস্পট’ কক্সবাজার!

ঢাকা মেইল: সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগ দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করছে। এগুলো কী কাজ করছে না?

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ: মশা মারতে ব্যবহৃত কীটনাশক কতটা কাজ করছে তা বলা কঠিন। কীটনাশক যদি কাজ না করে, আর প্রাপ্তবয়স্ক এডিস না মরে, তাহলে তাদের জীবনকাল লম্বা হবে। যতদিন পর্যন্ত এরা বেঁচে থাকবে ততদিন তারা ডেঙ্গু ছড়াতে থাকবে। আর এর মধ্যে যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে আরেকটা প্রজন্ম হবে। এ রকম হলে সারাবছরই আমাদের ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হবে।

dengue1

তবে এ নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের আদৌ কোনো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বা এটা প্রতিরোধ করতে যে বড় কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আসলে স্বাস্থ্য তাদের কাছে থাকা উচিত না। আমাদের একদেশ এক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যাওয়া দরকার। স্বাস্থ্য বিভাগ যদি দায়িত্ব পায় তাহলে এর থেকে ভালো করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, চিকিৎসা দেওয়া তার দায়িত্ব, মশা নিয়ন্ত্রণ না। এটি তো সত্যি কথা। তাই আমি একদেশে এক স্বাস্থ্য স্লোগান দিচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর এটিকে তাদের ইশতেহারে যোগ করা উচিত। কেননা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে এটি জরুরি।

আরও পড়ুন: ৭৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী ঢাকায়, মৃত্যু বেশি বাইরে

ঢাকা মেইল: ডেঙ্গু পরীক্ষায় ফি নির্ধারণে বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ: এটি কোনো অবস্থাতেই যৌক্তিক নয়। আমি ২০১২ সালে কালা জ্বরের পরীক্ষা বিনামূল্যে করে দিয়েছিলাম। এখনও সেটি চলমান আছে। আমি শুধু একজন ডিরেক্টর ছিলাম। সেখানে মন্ত্রী মহোদয় যদি চান, ডেঙ্গুসংক্রান্ত সকল পরীক্ষা ও ওষুধ বিনামূল্যে করে দিতে পারেন। মহামারিকালে এমনই হয়। মনে করেন একটা ঘূর্ণিঝড় হলো, আপনি খাবার দিচ্ছেন। আপনি কি তার জন্য টাকা নেবেন? অবশ্যই না, এটাও একটি দুর্যোগ। এ সময় টাকা নেওয়া ঠিক না। মাত্র এই ১০০ টাকার জন্য হয়তো একটা লোকের জীবন যেতে পারে। হয়তো ওই মুহূর্তে তার পক্ষে টাকাটা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে পরীক্ষা না করিয়েই তিনি বাড়ি ফিরেছেন। ফেরার পর তার অবস্থার অবনতি হলো, সে মারা গেল। তাহলে মাত্র ১০০ টাকার জন্য মৃত্যুর এই দায়টা কে নেবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। তাদের মতে, ইউজার ফি-র নামে যা গ্রহণ করা হয় তা স্বাস্থ্যসেবার বড় অন্তরায়। এ ধরনের ইউজার ফি গ্রহণ করাই উচিত নয়।

এমএইচ/জেবি   

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর