রোববার, ৫ মে, ২০২৪, ঢাকা

‘বেসামাল’ ডেঙ্গু: দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ছে মৃত্যু

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ২০ অক্টোবর ২০২২, ১১:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

‘বেসামাল’ ডেঙ্গু: দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ছে মৃত্যু

ডা. আসাদ শিকদার, রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এমডি/এমএস কোর্সের পালমোনলজির ফেইজ-বি’র একজন রেসিডেন্ট। তরুণ এই চিকিৎসক চলতি অক্টোবরে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। পরে মানিকগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ অক্টোবর মারা যান তিনি। ডেঙ্গু নিয়ে ওইদিন সকালেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এই চিকিৎসক। তবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মৃত্যু হয় ৩৩তম বিসিএসের চিকিৎসক ক্যাডারের এই কর্মকর্তার।

চলতি বছর মশাবাহিত এই রোগটিতে ডা. আসাদের মতো একই ভাগ্য বরণ করছেন অসংখ্য মানুষ। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ১১০ জন অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। এরমধ্যে শুধু চলতি মাসের ২০ দিনেই মারা গেছেন ৫৫ জন। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ।


বিজ্ঞাপন


Dengueস্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে মোট ২৮ হাজার ৬৯৮ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকার ৫২টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৪১৪ জন এবং ঢাকার বাইরে আট হাজার ৯৮ জন।

এদিকে, মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মোট ১১০ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫ জন ঢাকায় এবং ৪৫ জন দেশের অন্যান্য স্থানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

আক্রান্ত ও মৃত্যুর মাসভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১২৬ জন। পরের মাসগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ২০, এপ্রিলে ২৩ এবং মে মাসে ১৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এরমধ্যে প্রথম পাঁচ মাসে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

তবে জুন মাসে হঠাৎ করেই পাল্টে যায় ডেঙ্গুর চিত্র। এই মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৭৩৭ জন, আর মারা যায় একজন। পরে জুলাই মাস থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। এই মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এক হাজার ৫৭১ জন। এছাড়া আগস্টে তিন হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে নয় হাজার ৯১১ জন এবং অক্টোবরের ২০ তারিখ পর্যন্ত ১২ হাজার ৬০৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর প্রথম পাঁচ মাস মৃত্যুশূন্য থাকলেও পরের চার মাসে যথাক্রমে ৯, ১১, ৩৪ এবং ৫৫ জন মারা গেছেন।


বিজ্ঞাপন


Dengueএই হিসেবে অন্য যে কোনো মাসের তুলনায় অক্টোবর মাসে আক্রান্তের হার অনেক বেশি। এমনকি আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও। ফলে রোগীর সংখ্যা এই হারে বাড়তে থাকলে শয্যা সংকটসহ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর কারণ হিসেবে সঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসা এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসা শুরুকে দায়ী করছেন তারা।

এমনকি খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সিট সংকটের আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, ডেঙ্গু রোগী কমাতে মশা নিধনের বিকল্প নেই। এই হারে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে থাকলে হাসপাতালে সিট সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।

দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ছে মৃত্যু

সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী মিললেও সর্বাধিক রোগী রাজধানী ঢাকায়। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই এখন পর্যন্ত ২০ হাজার ৬০০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই হাজার ১৫৯ জন বর্তমানে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর এসব হাসপাতালে এখন পর্যন্ত মোট ৬৫ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ১২ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এবং ১০ জন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে মৃত্যুবরণ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সাধারণত খুবই ক্রিটিক্যাল রোগী আসে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। অন্য হাসপাতালগুলোতে যাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন, এ ধরনের রেফারেল পেশেন্ট আমাদের এখানে বেশি আসে। অনেকে এমন সময় আমাদের কাছে আসে যখন আসলে আর কিছুই করার থাকে না। ফলে এ ধরনের রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই রোগীদের মারা যাওয়ার কারণ তারা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ফুসফুসে রক্তক্ষরণ ও হার্টের মায়োকার্ডিটিসের কারণে মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে শকে চলে যাওয়া মানে কিছুটা জটিল। অধিকাংশ বাচ্চা আমাদের এখানে শক অবস্থাতেই ভর্তি হয়। কিন্তু কোনো বাচ্চা যদি দীর্ঘ সময় শকে থাকে তখন তা ক্রিটিক্যাল হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাদের চিকিৎসা দেওয়াটা কঠিন। প্রাথমিক অবস্থাতেই যদি তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাহলে জীবন বাঁচানো যায়। কিন্তু দেরি করে আসলে তাদের জটিলতা অনেক বেড়ে যায়।’

রোগী আরও বাড়লে দেখা দেবে সিট সংকট

হাসপাতালে পর্যাপ্ত সিট আছে জানিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নাজমুল বলেন, ‘আমাদের এখানে সিটের কোনো সংকট নেই। তবে যেভাবে রোগী বাড়ছে তাতে সিটের সংকট দেখা দিতে পারে। যদিও আমাদের সিটের সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। যত রোগীই আসুক আমরা তাকে ভর্তি ও চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে তা কঠিন হয়ে যাবে।’

Dengueবিষয়টি নিয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের এখানে ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। আমাদের ৭০০ শয্যার হাসপাতাল। যা প্রায় সব-সময় রোগীতে পরিপূর্ণ থাকে। ডেঙ্গুর প্রভাবে সেই চাপ আরও বেড়েছে। আর আমরা সাধারণত ডেঙ্গু রোগীকে ফেরত দেই না। শয্যা খালি সাপেক্ষে সকলকেই ভর্তি নেওয়ার চেষ্টা করি। রাতের বেলায় তা কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। রাতে কাউকে ভর্তি নিতে না পারলেও সকালে আমরা শয্যা খালি করে হলেও ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেই। রোগী বাড়ার এই হার যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন হবে।’

এমএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর