বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

ডেঙ্গু চিকিৎসার অন্তরায় অতিরিক্ত পরীক্ষা ব্যয়

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৫:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ডেঙ্গু চিকিৎসার অন্তরায় অতিরিক্ত পরীক্ষা ব্যয়

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাহিদ হাসান। একটি বেসরকারি কলেজের এই শিক্ষার্থী গত আগস্ট মাসের শেষে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে অবস্থানসহ দীর্ঘ চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হলেও দুর্বলতাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। তবে অসুস্থ অবস্থায় শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি বিপুল আর্থিক ক্ষতিরও মুখোমুখি হচ্ছেন এই শিক্ষার্থী। রোগ নির্ণয়সহ শুধু ডেঙ্গুসংক্রান্ত পরীক্ষা করাতেই নানা ছাড়সহ তার পাঁচ হাজারের বেশি টাকা খরচ হয়েছে।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নাহিদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত মাসের শেষে টানা কয়েক দিন আমি প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলাম। জ্বরের বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে তিনি ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং পরে অবস্থার অবনতি হয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর বাসায় ফিরে আসি।’


বিজ্ঞাপন


চিকিৎসার খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসায় মোট কত খরচ হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলতে পারছি না। শনাক্তকরণসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা আমাকে করতে হয়েছে। এর মধ্যে এনএস-১, সিবিসি, শ্বেত রক্তকণিকা কাউন্ট, হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা, হেমাটোক্রিট সেল বা পিসিভি এবং সিআরপি পরীক্ষা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এই পরীক্ষাগুলো করেছি। বেশকিছু ডিসকাউন্ট পাওয়াসহ আমার পরীক্ষা পেছনেই পাঁচ হাজারের বেশি টাকা খরচ হয়েছে।’

আরও পড়ুন: দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে ডেঙ্গু

পরীক্ষায় অধিক অর্থ খরচের বিষয়ে আব্বাস আলী নামে রাজধানীর অপর এক বাসিন্দা কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমার জ্বরসহ ডেঙ্গুর বেশকিছু লক্ষণ ছিল। এই অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিই। আমার জানামতে সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি ৫০০ টাকা, সিবিসি পরীক্ষার জন্য ৪০০ টাকা হওয়ার কথা। তবে চিকিৎসক আমাকে সিবিসি, ব্লাড কালচার, ইউরিন এবং ডেঙ্গু টেস্ট দিয়েছিলেন। যা করতে আমার ধারণার বাইরে অর্থ খরচ হয়েছে।’


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: গরম ও থেমে থেমে বৃষ্টিতে বাড়ছে জ্বর-সর্দি-কাশি

নাহিদ এবং আব্বাসের মতো প্রায় সব সম্ভাব্য ডেঙ্গুরোগী ও চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা পরীক্ষার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা বলেছেন। যা রোগীদের চিকিৎসায় অনেকাংশেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে রোগীরা শারীরিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। তবে এতসব পরীক্ষার কতটুকু প্রয়োজনীয়তা আছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

কী ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী শনাক্তে ইউরিন বা ব্লাড কালচারের মতো পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। ডেঙ্গু রোগীদের শনাক্ত ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ আছে। প্রথমত জ্বর হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে এনএস-১ পরীক্ষা করাবে। আর সাত দিনের মধ্যে আইডিএম টেস্ট করাবে অর্থাৎ এন্টিডেঙ্গু আইজিএম পরীক্ষা করবে। সাত দিনের পরে এই পরীক্ষাগুলোর আর প্রয়োজন নেই। এ সময় পিসিভি বা হেমাটোক্রিট রেসিও পরীক্ষা করাতে হবে। এটা জানাই আমাদের জন্য বেশি প্রয়োজনীয়।’

dengue2

ডেঙ্গুসংক্রান্ত গাইডলাইনে ত্রুটি রয়েছে কি না যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গাইডলাইনে এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সঠিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না। ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘটে যদি হেমাটোক্রিট সেল পিসিভি বেড়ে যায়। প্লাটিলেট বা সিবিসি খুব বেশি মৃত্যু ঘটায় না বলা যায়। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকরা সিবিসি পরীক্ষাই সবথেকে বেশি করায়। এটাতে মূলত রক্তের প্লাটিলেট জানা যায়। যা আদৌ দরকার নেই। ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমি উপরে উল্লিখিত ধাপে ধাপে আগাবো। এক্ষেত্রে পিসিভি যদি বেশি থাকে তবে তা মারাত্মক। রোগী যেকোনো সময় সকে চলে যেতে পারে। রোগীর কিডনি ও লিভার ফেইলিউর হতে পারে। অর্থাৎ পিসিভি বাড়তে দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ব্লাড, ইউরিন কলচার অনেকাংশের অযথা পরীক্ষা। এতে রোগীদের টাকা নষ্ট হয়। এটা বন্ধে সরকারকে প্রতিটি ধাপ নির্দিষ্ট করে নির্দেশনা দিতে হবে।’

আরও পড়ুন: ওষুধের অধিক ব্যবহার: প্রয়োজনীয়তা নাকি নির্ভরশীলতা

এ অবস্থায় সরকারের গাইডলাইনটি আরও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গাইডলাইন এমন হওয়া উচিত যাতে করে রোগীদের খরচ কম হয়। সরকার চাইলে এই খরচটা কমানোর উদ্যোগ নিতে পারে। ব্যয় কম হয় এমন একটি গাইডলাইন করতে হবে এবং সব সরকারি হাসপাতালে তা ফলো করতে হবে। একইসঙ্গে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করতে হবে। পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিস যারা করেন তারাও যেন এই নির্দেশনা মেনে চলে তা পত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।’

সব পরীক্ষার খরচ সুনির্দিষ্ট করা উচিত

স্বাস্থ্যসেবার নামে বাণিজ্য চলছে মন্তব্য করে স্বাস্থ্যের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশে চাল, তেল, ডালের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। মনে করি ডালের পাইকারি দাম যদি ১০০ টাকা নির্ধারণ করা আর বিক্রেতা যদি তা ১৫০ টাকায় বিক্রি করে তাহলে সেই বিক্রেতাকে দুই হাজার টাকা জরিমানাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে দিতে পারে। চাল ডালের দাম নির্ধারিত থাকলে পরীক্ষার দাম কেন নির্ধারিত করা হবে না? এই অস্পষ্টতার অপব্যবহার করছে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। এই সুযোগে দেশে স্বাস্থ্যসেবার পরিবর্তে স্বাস্থ্য বাণিজ্য চলছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষার মতো এ সংক্রান্ত সকল পরীক্ষার খরচ নির্ধারিত করে দেওয়া উচিত।’

এমএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর