সরকারি চাকরিতে প্রায় এক দশক পার করে পদোন্নতি পান চিকিৎসকরা। আর পদোন্নতি পেতে নিতে হয় কয়েকটি ডিগ্রি। পদোন্নতি পাওয়ার পর তাদের জোটে ‘জুনিয়র কনসালটেন্ট’ পদবি। এই টার্মে অপমানিত বোধ করেন চিকিৎসকরা। এত ডিগ্রি লাভের পরও পদবির সঙ্গে ‘জুনিয়র’ শব্দটিকে তারা বেমানান বলে মনে করেন। বিষয়টি সুরাহার কথা অনেক দিন ধরে শোনা গেলেও এখনো তা কার্যকর হচ্ছে না। এতে ক্ষুব্ধ ও হতাশ চিকিৎসকরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বাংলাদেশে অনেক কিছু যখন পরিবর্তন হচ্ছে তখন চিকিৎসকদের জোরালো দাবি, নিজেদের পদবির সঙ্গে ‘জুনিয়র’ শব্দটি বাদ দেওয়া। অন্যান্য পেশার মতো ধাপে ধাপে জ্যেষ্ঠতার পদবি দেওয়ার দাবি তাদের।
চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বিসিএস পাস করে স্বাস্থ্য ক্যাডারে চাকরিতে প্রবেশের পর চিকিৎসকরা হন সহকারী সার্জন। পরের ধাপের পদোন্নতির জন্য তাদের নিতে হয় এমডি-এমএস বা অন্যান্য ডিগ্রি, তারপর আবেদন করতে হয় পদোন্নতির জন্য। এতে পদোন্নতি পেতে সময় লাগে ৭-১০ বছর বা কারো কারো ক্ষেত্রে আরও বেশি। পদোন্নতি পাওয়ার পর চিকিৎসকরা হন ‘জুনিয়র কনসালটেন্ট’। অর্থাৎ পদোন্নতিতে নামের আগে ‘জুনিয়র’ যুক্ত হয়।
বিজ্ঞাপন
যদিও স্বাস্থ্য ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারে ধাপে ধাপে সিনিয়র পদবি দেওয়া হয়। আর চিকিৎসকদের বেলায় সেটি নেই। যেমন– একজন শিক্ষার্থী প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার পর তার পদবি হয় সহকারী কমিশনার, এরপর পদোন্নতি পাওয়ার পর তার পদবি হয় সিনিয়র সহকারী কমিশনার। এভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান।
পদবিতে ‘জুনিয়রের’ তকমা থাকায় চাকরি জীবনের মূল্যবান রত্ন পদোন্নতি পাওয়ার পরও চিকিৎসকদের সন্তুষ্টি যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অতৃপ্তির অন্ধকারে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অন্য ক্যাডারে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র হলেও চিকিৎসকদের বেলায় হচ্ছে জুনিয়র কনসালটেন্ট, এটা পরিবর্তন করা এখন সময়ের দাবি। এ পদবি পরিবর্তন করে কনসালটেন্ট কিংবা সিনিয়র কনসালটেন্ট করা হোক। এতে সরকারের বাড়তি কোনো ব্যয় হবে না, একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার আদেশ করলেই হবে। তাদের বক্তব্য- দেশে তো কত কিছুই পরিবর্তন ও সংশোধন করা হচ্ছে। এটি চিকিৎসকদের একটি সম্মানের বিষয়। এতে কাজে উৎসাহ ও উদ্দীপনা পাবেন চিকিৎসকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য ক্যাডারে কর্মরত একজন চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে আট বা ১০ বছর চাকরি করার পর নামের আগে পদবি হিসেবে জুনিয়র শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়, তখন অতৃপ্তি বা হতাশা তৈরি হয়। কেননা, অন্যান্য ক্যাডারে কর্মরত বন্ধু বা ব্যাচমেটদের পদবিতে থাকে সিনিয়র পদবি, আর আমার নামের আগে পদবিতে লেখা জুনিয়র। অথচ কনসালটেন্ট নামে কোনো পদই নাই। এফসিপিএস, এমডি-এমএস কিংবা রেসিডেন্সি কোর্স করার পর একজন চিকিৎসকের একটি পদোন্নতি হয়, আর নামের আগে দেওয়া হয় জুনিয়র শব্দ। এটা অসঙ্গতিপূর্ণ এবং বৈষম্যমূলক।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, চিকিৎসকরা দীর্ঘ সময় ধরে দাবি জানাচ্ছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করছেন পদবিসংক্রান্ত ঝামেলা দূর করার জন্য। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এটি আসলে তেমন বড় কিছু নয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নিলেই হয়। সরকার চাইলেই পরিবর্তন করে দিতে পারে অথবা সরকার চিন্তা-ভাবনা করে সম্মানজনক পদবি ঠিক করে দিতে পারে।
আরেকজন চিকিৎসক বলেন, সিনিয়র চিকিৎসকরা পদবিসংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাতে ‘জুনিয়র’ শব্দ বাদ দিতে বলা হয়েছে এবং পদবি হবে কনসালটেন্ট বা সিনিয়র কনসালটেন্ট। চিফ কনসালটেন্ট পদবিও আসবে। এটি নিয়ে কিছু কাজও হয়েছে। পদবিসংক্রান্ত প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে গেছে। এটা এখনো সরকার পাস করেনি, ঝুলে আছে।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য ক্যাডারে চাকরিতে যোগদানের পর একজন চিকিৎসক অন্তত দুই বছর গ্রামে থাকতে হয়। পরে প্রচুর পড়াশোনার ডিগ্রির (ডিপ্লোমা, রেসিডেন্সি বা এফসিপিএস) প্রস্তুতি নিতে হয়, কারো ভাগ্য ভালো থাকলে একবার চান্স পান, না হয় অনেকবার চেষ্টা করতে হয় ডিগ্রির পরীক্ষায় পাস করার জন্য। ডিগ্রির কোর্স শেষ করার পর চাকরিতে পদোন্নতি পান জুনিয়র কনসালটেনন্ট হিসেবে, এটি কষ্টের এবং মেনে নেওয়ার মতো নয়। এটি বৈষম্য তৈরি করে।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশে এসে সার্জারি শিখছেন মালয়েশিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!
‘একসঙ্গে এত বাচ্চার চিকিৎসা আগে হয়নি, চিকিৎসকরাও সেদিন কেঁদেছেন’
ভোলায় কর্মরত একজন চিকিৎসক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা অনেক চিকিৎসক গ্রামে কাজ করি এবং প্রতিবন্ধকতা থাকে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন এবং চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ডিগ্রি নিয়ে আসার পরও পদবিতে নামের শুরুতে ‘জুনিয়র’ থাকায় অনেকে মনে করেন জুনিয়র চিকিৎসক। ভাবেন, জুনিয়র কনসালটেন্ট আর কতটুকু বোঝেন! আসলে আমরা তো ডিগ্রি নিয়ে এসেছি এবং কয়েক বছরের অভিজ্ঞ, এরপরও এমন পদবি নিয়ে থাকতে হবে- এটা মানা যায় না।’
আরেকজন চিকিৎসক বলেন, ‘পুলিশে দেখেছি, এএসপির পরে সিনিয়র এএসপি হয়। সহকারী সচিবের পরে করা হয় সিনিয়র সহকারী সচিব। আমাদের নার্সরা চাকরিতে যোগদান করেন সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে। আমরা এত ডিগ্রি নেওয়ার পর অর্জন করি ‘জুনিয়র কনসালটেন্ট’ পদ। নন-মেডিকেল আত্মীয়-স্বজন এ কথা শুনে বলাবলি করেন, ওর মনে হয় চাকরিতে অবনতি হয়েছে।’
চিকিৎসকদের পদবিসংক্রান্ত এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক উপপরিচালক ডা. তাহাজ্জল হোসেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দাবি ছিল জুনিয়র কনসালটেন্ট শব্দটা লেখা যাবে না। এর বদলে শুধু কনসালটেন্ট হবে। এর পরের পদোন্নতিতে হবে সিনিয়র কনসালটেন্ট। এরপর চিফ কনসালটেন্ট। অথবা কেউ শিক্ষকতায় গেলে হবেন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। পরে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। এ ধরনের একটি প্রস্তাবনা ছিল। প্রথমে এটি স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাঠাই। তারা বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী, অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা। এ নিয়ে কারও কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। এটা এভাবে পড়ে আছে।’
ডা. তাহাজ্জল হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) সুনীল কুমার সরকারের তত্ত্বাবধানে ২০১৯ সালে আড়াইশ’ বা একশ’ শয্যার হাসপাতালের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। ওইসব হাসপাতালে কতগুলো ইউনিট হবে, প্রতি কতজন চিকিৎসক থাকবেন, তাদের পদবি কী হবে—এ সংক্রান্ত বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। সেখানে উচ্চতর ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের পদবি কনসালটেন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উদ্যোগ নিলেই হয়ে যেতে পারে। নতুন হাসপাতালের বিন্যাসের আলোকে চিকিৎসকদের পদ-পদবিগুলোও যুক্ত হওয়া উচিত। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেই হবে।’
আরও পড়ুন
নানা সংকটে নার্সিংখাত, আধুনিকায়নে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা
‘মেডিকেল লাইফ কোনো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট না, বরং ম্যারাথন’
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জুনিয়র কনসালটেন্ট পোস্টটি চলে আসছে অনেক বছর ধরে। চিকিৎসকরা পরিবর্তন করার কথা বলছেন এবং অনেকের মনে ক্ষোভও রয়েছে। দেশে তো এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে। পদবিসংক্রান্ত এ সমস্যারও সমাধান করা যায় এবং যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবা সচল রাখেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাদের সন্তুষ্ট রাখাও সরকারের দায়িত্ব। পদবিসংক্রান্ত বিষয়টি আত্মমর্যাদার বিষয়। এতে তাদের কাজের গতি বাড়বে। দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ আরও বাড়ে।’
এবিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে প্রস্তাবনা আকারে। কেবিনেটে পাস করতে হবে। এ পদবি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে। আশা করি, বিষয়টি আশার আলো দেখবে শিগগিরই। মন্ত্রণালয় কাজ করছে।’
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসকদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। চিকিৎসকরাই দেশের স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রেখেছেন। স্বাস্থ্যখাতে তাদের অবদান অনেক। চিকিৎসকদের যত ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করা হবে।’
এসএইচ/জেবি

