২১ জুলাই ২০২৫। ঢাকায় নেমে আসে এক দুর্বিষহ দিন। সেদিন দুপুরে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণরত বিমান দুর্ঘটনা হয়। হৃদয়বিদারক এক ঘটনার অবতারণা হয়, শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো দেশ। দুর্ঘটনায় শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক আহত এবং নিহত হন। আহত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই সময়ে আশা ভরসার প্রতীক হয়ে উঠে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। এই হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন গুরুতর রোগী। তাদের কেউ কেউ মারা গেছেন, আবার কেউ কেউ এখনো চিকিৎসাধীন।
এতগুলো শিশুকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা হাসপাতালটির জন্য এটাই প্রথম। আইসিইউতে শিশুদের সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতাসহ সেদিনের নানা ঘটনা ঢাকা মেইলের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছেন জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অ্যানেসথেশিয়া ও আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল। সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের নিজস্ব প্রতিবেদক সাখাওয়াত হোসাইন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা মেইল: চিকিৎসক হিসেবে সেদিনের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল: দুপুরের সময়। ডিউটি শেষ। কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে বের হয়েছেন। আবার কেউ বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত ডিউটি থাকে। কেউ আবার রাতের ডিউটি করতে আসবেন। আরেক গ্রুপ ছিলেন ছুটিতে। আর যারা বের হয়ে গেছেন, তারা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হঠাৎ দেখেন মেসেজ আসছে- অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে (মাস ক্যাজুয়ালিটি)। সাধারণ দুর্ঘটনায় কিছু রোগী এই হাসপাতালে আসে। আর যদি আগুন লাগে তাহলে আমরা আরও বেশি অ্যালার্ট হয়ে যাই। এই হাসপাতালে যারা চাকরি করেন, তাদের সেটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
আর ওইদিন হেড অব ডিপার্টমেন্ট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চিকিৎসকদের মেসেজ দিয়েছেন, একটা বিমান দুর্ঘটনা হয়েছে এবং আগুন লেগেছে। অনেক বার্ন রোগী আছে। তারা আসছে। সবাই চলে এসো হাসপাতালে। তখন সবাই সাথে সাথে রেসপন্স করেন এবং বলেন, আমরা (বার্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা) আসছি এবং যে যে অবস্থায় আছে, সে সে অবস্থায় হাসপাতালে চলে আসেন। আমার আসতে প্রায় ২০ মিনিট লেগেছে। সেদিন পরিচালক স্যারের কী যেন একটা মিটিং ছিল, তিনিও চলে আসেন। এখানে এসে দেখি, হাসপাতালের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন এবং ম্যাসাকার অবস্থা। এখানে একটা বাচ্চা, ওখানে একটা বাচ্চা। দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে।
আরও পড়ুন
দশকের পর দশক ধরে অকার্যকর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা
সুফল মিলছে না দেড় হাজার কোটি টাকার বিশ্বমানের হাসপাতালটির
বার্ন রোগীরা যখন আসেন, তখন কয়লার মতো তাদের চেহারা বা শরীর থাকে। আর আমরা সাধারণত এডাল্ট রোগী দেখে অভ্যস্ত। আর এখন যারা এসেছে তারা সবাই বাচ্চা। কেউ ক্লাস ফাইভে পড়ে, কেউ ক্লাস সিক্স-সেভেনসহ বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। আমাদের মোটামুটি সবারই এই বয়সী বাচ্চা আছে। কেউ কান্না করছে, কেউ শ্বাস নিতে পারছে না। রোগীদের অক্সিজেন এবং স্যালাইন দেওয়া হয়। বার্ন রোগীরা শকে চলে যান এবং প্রেশার কমে যায়। যার কারণে স্যালাইন দিতে হয়। ক্যানুলা এবং সিভিল্যান ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক রোগীকে ধরে ধরে এই সেবা দেওয়া হয়েছে। এসময় আমাদের কিছু সহকারী প্রয়োজন পড়ে, হাত ধরে রাখতে হয় এবং কাঁধটাকে একদিকে কাত করে রাখতে হয়। এত রোগী, ওয়ার্ড বয় তো এত নেই। তবে হাসপাতালের চিকিৎসকরাই (এসআর, ইডি স্যার, ডিডি স্যার) ওয়ার্ড বয়দের মতো সহযোগিতা করেছেন।
কেউ রোগীদের হাত ধরে রেখেছেন এবং কেউ কাঁধ কাত করে রেখেছেন। যে যেভাবে পেরেছেন আমাদের সহযোগিতা করেছেন। যে যার কাজ না, তারপরও তিনি অপরকে সহযোগিতা করেছেন। আমাদের আরএস ডা. শাওন, তিনি রোগীকে ঠেলে নিয়ে গেছেন এবং আমি একজন রোগীকে ইর্মাজেন্সি থেকে আইসিইউতে নিয়ে আসছি। আর চিকিৎসকরা চিন্তা করছেন, কোন রোগী কোথায় যাবে। কিছু রোগী ছিল খুবই সিরিয়াস, এই রোগীগুলো যাবে আইসিইউতে। সাথে সাথে সাতজন রোগীকে আইসিইউতে নিয়ে আসা হয়। এরপর কিছু রোগীকে এইচডিওতে পাঠানো হয়, সেখানেও একযোগে প্রায় ২০ চিকিৎসক কাজ করেন এবং রোগীদের সেবা প্রদান করেন।
আইসিইউর আমার অভিজ্ঞতাটা হলো আমার সঙ্গে দুজন কলিগ ছিলেন। তাঁরা (চিকিৎসক) বাচ্চাদের দেখে অনেক কান্না করেন। ওই সময়ের পরিস্থিতিটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ওদের অবস্থা দেখে, আমার চোখেও পানি চলে আসে। যাই হোক, এভাবে ইমোশন আটকিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছে।
ঢাকা মেইল: হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের সহযোগিতা কেমন ছিল?
ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল: তাদের সহযোগিতা ব্যাপক ছিল, যা যা লাগবে, তাই করেছে। পুরোপুরি সহযোগিতা করেছে। স্যালাইনসহ যা যা লেগেছে, সবকিছু হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। আমাদের আউটসাইট থেকে আনতে হয়নি।
আরও পড়ুন
ঢামেকের সেই বীভৎস চিত্র দেখে কেঁদেছেন অনেকেই
অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত ঢামেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গী ‘মৃত্যুঝুঁকি’
ঢাকা মেইল: বাচ্চাদের স্বজনদের পরিস্থিতি কেমন দেখেছেন?
ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল: বাচ্চাদের অভিভাবকরা সেই পরিস্থিতিতে দিশেহারা ছিলেন। তাদের চাওয়া ছিল, বাচ্চা যেন সুস্থ হয়। আর আমরাও সাপোর্ট দিয়েছি, যতটুকু পেরেছি। ওই সময়ে অভিভাবকদের কিছু বলার ছিল না। স্বজনদের ইমোশন আমাদের আটকাতে হয়েছে। তাদের কেউ কেউ আইসিইউতে আসতে চায়, এইচডিওতে আসতে চায়। আর এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাচ্চা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, অভিভাবক ইমোশোনাল হওয়ারই কথা। আর আইসিইউতে তো অনুমতি দেওয়া যায় না, নিয়ম পদ্ধতি ফলো করতে হয়। কোনো সময় আমাদের হার্ড হতে হয়েছে। এখানে আসা যাবে না এবং ভিড় করা যাবে না- সেটা আমরা বলেছি। তবে কারও সঙ্গে আমাদের মিস ব্যবহার হয়নি।
ঢাকা মেইল: রোগীদের শারীরিক অবস্থা এখন কেমন?
ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল: আইসিইউর কয়েকজন রোগী মারা গেছেন। কারণ তারা বার্ন আক্রান্ত ছিলেন। কারও কারও ৮০ শতাংশ ছিল, আর একজন ছিল ১০০ শতাংশ বার্ন। মানে পুরো শরীর আগুনে দগ্ধ হয়েছে। আর আমরা বলি, ২০ শতাংশের উপরে হলেই মেজর বার্ন। সেখানে ২০ শতাংশের জায়গায় ৮০ শতাংশ বার্ন, অনেক মারাত্মক পরিস্থিতি ছিল। আমাদের পক্ষ থেকে রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা মেইল: এই কয়েক দিনে বাচ্চাদের সঙ্গে আপনাদের কোনো সখ্য গড়ে উঠেছে কি?
ডা. নাজমুল আহসান সিদ্দিকী রুবেল: রোগীদের সবাই ভালো পরিবারের বাচ্চা। আদরে বড় হচ্ছে। তাদের আব্বা আম্মা, তাদের কষ্ট করতে দেয়নি। বাচ্চাদের কখনও ব্যথা পেতে দেয়নি। আমাদের বাচ্চারা তো এভাবেই আদরে মানুষ হয়। এই বাচ্চাদের হাতে ব্যথা, পায়ে ব্যথা, শরীর জ্বলছে এবং চামড়া উঠে যাচ্ছে। তখনই খুবই অস্থির হয়ে যায় বাচ্চারা, তাদের টেকনিক করে, আদর দিয়ে এবং বুঝিয়ে সেবা দিতে হয়। আর সবসময় ওষুধ দিয়ে হয় না এবং আরও কিছু লাগে, মানবিকতা প্রয়োজন। আমরা চেষ্টা করছি সবটুকু দিয়ে তাদের সেবা করার।
এসএইচ/জেবি

