শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

১০ জনের ৬ জনই ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত, সতর্কতার তাগিদ

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম

শেয়ার করুন:

health
বেড়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপ। ছবি কোলাজ: ঢাকা মেইল

দেশে প্রতি বছরই বর্ষা ও শীতকালে সর্দি, কাশি ও জ্বরের প্রকোপ বাড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। চিকিৎসা নেওয়া ১০ জনের মধ্যে ছয়জনই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত। এ অবস্থায় ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে সতর্কতার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার আগে নিতে হবে টিকা। এতে থাকা যাবে ঝুঁকিমুক্ত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইনফ্লুয়েঞ্জা মারাত্মকভাবে শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশু, বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা। এই ভাইরাসটির জটিলতার কারণে পরে নিউমোনিয়া, ফুসফুসে প্রদাহ, সাইনাস ইনফেকশন, শিশুদের ক্ষেত্রে মধ্যকর্ণের ইনফেকশন, দীর্ঘমেয়াদি অ্যাজমা বা হাঁপানি দেখা দেয়। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে হার্টের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। এই ভাইরাসে আক্রান্তরা নানা জটিলতায় মারাও যেতে পারে।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে যৌথ জরিপ প্রকাশ করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। জরিপ অনুযায়ী, দেশে বছরের যেকোনো সময়ই ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে। তবে বর্ষা আর শীতকালে প্রকোপ থাকে বেশি। ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ সর্বোচ্চ হয় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে।

জরিপের তথ্য বলছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভেলেন্স থেকে প্রাপ্ত চলতি বছরের জুলাই মাসের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২৪৫৫ জন সম্ভাব্য ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগীর নমুনা পরীক্ষায় ১৪৫৩ জন রোগীর ইনফ্লুয়েঞ্জা শনাক্ত হয়, যা নমুনা পরীক্ষার ৫৯.২ শতাংশ। এছাড়া এটি সার্ভে কার্যক্রমের শুরু থেকে এ যাবত কালের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হার।

আরও পড়ুন

ফের বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, বেশি আক্রান্ত শিশুরা

সার্ভেলেন্সের তুলনামূলক একটি চিত্রে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাইয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা শনাক্তের হার ৫৯.২ শতাংশ, যেখানে গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ২১.৫ শতাংশ। অবশ্য সে বছরের সর্বোচ্চ শনাক্তের হার ছিল ৩৪.৬ শতাংশ, যা শনাক্ত হয়েছিল জুন মাসে। এরপর কাছাকাছি শনাক্তের হার মে মাসে ছিল ২৯.৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ শনাক্তের হার আগস্ট মাসে ছিল ৩৯.৭ শতাংশ। ওই বছরের জুলাইয়ে ৩৩.৪% এবং সেপ্টেম্বরে শনাক্তের হার ছিল ২৫.৭% শতাংশ।

RR
শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে। ছবি: ঢাকা মেইল

২০০৭ সাল থেকে পরিচালিত ইনফ্লুয়েঞ্জা নজরদারি কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ মৌসুমি এবং এটি প্রতিবারই মূল্যবান জীবন কেড়ে নিচ্ছে। সময়মতো টিকা দিলে বহু মৃত্যু ও গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধ সম্ভব।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রতিবছর সারা বিশ্বে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার লোক মারা যায়। আর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ গুরুতর অসুস্থ হন।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, ২০০৭ সালের মে থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণ নিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৮০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে ১১ দশমিক ৫ শতাংশের ইনফ্লুয়েঞ্জা শনাক্ত হয়। ৫ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় বেশি আক্রান্ত হন। ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে মারা যাওয়ার হার ১ শতাংশ।

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, এই ফ্লুকে অনেকেই অবহেলা করেন। কিন্তু এটাতে মানুষ মারাও যাচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য টিকা নেওয়ার পাশাপাশি সুলভমূল্যে টিকার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি।

টিকা নেওয়াসহ বিশেষজ্ঞদের যত পরামর্শ

বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে সুরক্ষা পেতে টিকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিতে হবে। দেশে যেহেতু এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুম, তাই ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মধ্যেই টিকা নিতে হবে। বিশেষ করে ৬০ বছরের বেশি, ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যারা হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগেন, তাদের টিকা এই সময়ের মধ্যে নেওয়া ভালো।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ছয় মাস বয়স থেকে শুরু করে সবার জন্য প্রতি বছর এ টিকা নেওয়া দরকার। তবে এটি যাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তারা হলো– ছয় মাস থেকে ছয় বয়স বছর বয়সী শিশু, পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি, গর্ভবতী মা, কিডনি ফেইলিউর, হৃদরোগ, অ্যাজমা কিংবা সিওপিডি আক্রান্ত ব্যক্তি। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদেরও টিকা নিতে হবে। এ ছাড়া যারা বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন হজব্রত কিংবা ওমরাহ পালন করার জন্য, তাদের জন্যও টিকা দেওয়া জরুরি।

আরও পড়ুন

বাড়ছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, দুশ্চিন্তায় স্বাস্থ্য বিভাগ

এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দুই সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রাচীর তৈরি হয়ে যায় এবং ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত এর স্থায়িত্বকাল থাকে। কোনো টিকাই ১০০ শতাংশ কার্যকর নয়। তবে টিকা দেওয়ার কারণে ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তীব্র ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। এর কারণে হাসপাতালে ভর্তির মাত্রা অনেক কমে যায়। তা ছাড়া কিছু রোগব্যাধি, যেমন– ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের তীব্রতা অনেকটা কমে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ হলে সাধারণ ঠান্ডা লাগার মতোই লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন জ্বর, গলাব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া, সর্দি, কাশি ইত্যাদি। সাধারণ ঠান্ডা লাগার সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের পার্থক্য হচ্ছে, এটি দ্রুত বেড়ে যায়। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে অন্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

RR3
হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়। ছবি: ঢাকা মেইল

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাসজনিত জ্বর মৌসুমি জ্বরের মতো। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে জ্বর অনেক বেশি বা কম হতে পারে। শরীরে ব্যথা থাকে। তীব্র মাথাব্যথা থাকে। কাশি থাকতে পারে। খুব দুর্বল লাগতে পারে। সর্দি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। অনেকটা করোনা বা ডেঙ্গুর লক্ষণের মতো। কখনো কখনো শরীরে র‌্যাশও হয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, মৌসুমি এই জ্বরের জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। এটি করোনা ভাইরাসের মতো। সাধারণত ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, কফ, থুথু ও সর্দির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়ায়। তিনি বলেন, ভাইরাল এই জ্বর এক বাসায় ঢুকলে একে একে সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। ভাইরাসটি খুবই দ্রুত ছড়ায়। ক্লাসিক্যাল জ্বর থেকে এবারের জ্বরের লক্ষণ কিছুটা ভিন্ন। শরীরে ব্যথা, কাশি, সর্দি, মাথা ব্যথা ও র‌্যাশ থাকছে। অনেক রোগী ভাইরাল জ্বর থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা ভিন্ন কোনো ভাইরাস কি না, তা পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে তা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সাপের কামড়ে মৃত্যু বাড়ছে, প্রতিষেধক তৈরির উদ্যোগ

চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকুনগুনিয়ার চেয়ে গায়ে ব্যথা কম হয়। চিকুনগুনিয়ায় হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা অনেক বেশি, মাংসপশিতে ব্যথা হয়ে থাকে। গায়ে দ্রুত র‌্যাশ চলে আসে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পাতলা পায়খানা হওয়া, পেটব্যথা—এগুলো একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। করোনা রোগীদের জ্বরের সঙ্গে কাশি, গন্ধ না পাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া এসব উপসর্গ ছিল। এখন কোভিড রোগীদেরও জ্বরের সঙ্গে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা, মাথা ব্যথার মতো উপসর্গ থাকছে। এসব পরীক্ষা ছাড়া আলাদা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, একাধিক রোগে ভোগা ব্যক্তিরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলে তাদের সঠিক চিকিৎসার অভাবে কখনো কখনো মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত অল্পতেই সেরে যায়। যদি জটিলতা দেখা দেয় বা শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয় অথবা ইলেকটোলাইট ইমব্যালেন্স হয়, তাতে রোগীকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে হতে পারে। কখনো কখনো মৃত্যু হতে পারে। সে জন্য এই সময়ে জ্বর হলে উদাসীন থাকা যাবে না। চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসক নিশ্চিত হয়ে সেভাবে চিকিৎসা দেবেন।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর