সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

বরগুনা কেন হয়ে উঠল ‘এডিসের আধার’

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৫:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

borguna
বরগুনায় মশার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে আট গুণ বেশি। ছবি: সংগৃহীত

এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সাধারণত রাজধানী ঢাকাতে বেশি লক্ষ করা যায়। তবে এবার অনেকটা ব্যতিক্রম। ঢাকার চেয়ে বাইরে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা উপকূলীয় জেলা বরগুনায়। চলতি বছর পুরো দেশে যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এর এক চতুর্থাংশ শুধু বরগুনাতেই।

সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) এক জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর ঢাকার বাইরে বরগুনা জেলায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। সেখানে এডিসের প্রজনন ভয়াবহ এবং এ মশার ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে আট গুণ বেশি। সারাদেশের চার ভাগের এক ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বরগুনা জেলায়।


বিজ্ঞাপন


আইইডিসিআরের জরিপকারীরা বরগুনা পৌর এলাকার ১৩৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৬৫টি পাত্রে এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পান। সদর উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪৬টি বাড়ি পরিদর্শন করে ৭৫টি পাত্রে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

জরিপে আরও দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ একতলা, ৩৩ শতাংশ আধা-পাকা ভবন, ৯ শতাংশ বহুতল ভবন এবং ২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী উপকরণ পাওয়া গেছে। জরিপ এলাকার যেসব বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ড্রাম এবং ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বালতি ছিল মূল ‘ব্রিডিং সোর্স’। এগুলো মূলত জমানো পানির জন্য ব্যবহৃত হয়।

Borguna11
ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা বরগুনার হাসপাতাল। ছবি: সংগৃহীত

জরিপ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সম্মিলিতভাবে ডেঙ্গুর ধরন ডেন ২ ও ৩ তে ১৪ শতাংশ আক্রান্ত। এরমধ্যে ডেন-৩ এ আক্রান্ত ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও ডেন-২ এ আক্রান্ত ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তদারকিও সীমিত পরিসরে।

বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসের সবশেষ (৪ জুলাই) তথ্য অনুযায়ী, আগের ২৪ ঘণ্টায় শুধু বরগুনা সদর হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭৩ জন। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ১৩ জন ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে বেতাগী ১, বামনা ৫, তালতলী ২ এবং পাথরঘাটায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫ জন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২২৩ জন।

এ বছর জেলায় এখন পর্যন্ত তিন হাজার ২৯১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিন হাজার ৬৮ জন। এছাড়া বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এখন পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। বরগুনার বাইরে চিকিৎসা নিয়ে মারা গেছেন আরও ২৩ জন। এ নিয়ে বরগুনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২৯ জন।

আরও পড়ুন

একসঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু ও করোনা, সচেতনতার তাগিদ

ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিলো সরকার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরগুনায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির প্রধান কারণ বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি, বিশেষ করে বৃষ্টির জমা পানি। এ পানি এডিস মশা বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। জেলায় সুপেয় পানির সংকট বেশি থাকায় পানি জমিয়ে রাখার প্রবণতাও বেশি। ড্রামের মধ্যে জমা রাখা হয় পানি। যার কারণে এই জেলাটিতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি তা এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী সবাই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে না, অনেকেই বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, আবার অনেকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে আমাদের মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, যারা হাসপাতালে না এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ইতোপূর্বে মারা গেছেন অথবা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের নাম-পরিচয়সহ সকল তথ্য সংগ্রহ করে জমা দিতে। যা যাচাই-বাছাই করে সঠিক তালিকা করা হবে। যাতে সরকারি ও বেসরকারি হিসাব একই থাকে।’

Borguna22
মশার উৎস ধ্বংসের চেষ্টায় প্রশাসন। ছবি: সংগৃহীত

সিভিল সার্জন বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ততই বাড়ছে। পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আমাদের চিকিৎসাসেবা ইতোমধ্যেই চাপে পড়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। স্থানীয়দের সচেতন হতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে এবং ব্যাপকভাবে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।’

জানতে চাইলে আইইডিসিআরের মেডিকেল সোশ্যাল সায়েন্স বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রত্না দাশ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বরগুনার পানিতে আয়রন বেশি থাকায় সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট। যার কারণে মানুষ ড্রামে পানি জমিয়ে রাখে। সুপেয় পানির সংকটের কারণে বরগুনা জেলায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রচলন আছে। আর এডিস মশার লার্ভা তৈরি হয় জমিয়ে রাখা পরিষ্কার পানিতে। এসব পানির আধারই হলো এডিসের বিস্তারের বড় ক্ষেত্র। বাড়িতে রাখা প্লাস্টিকের ড্রামের পানি ঢেকে রাখা হয় কাপড় দিয়ে। এটার চর্চা গ্রামে বেশি। আর এসব কাপড়ে ব্যাপক মাত্রায় লার্ভা পাওয়া যায়। ফলে ডেঙ্গু মশা জন্মায় এবং সেখান থেকে প্রাদুর্ভাব ঘটে।’

আরও পড়ুন

সুফল মিলছে না দেড় হাজার কোটি টাকার বিশ্বমানের হাসপাতালটির

নতুন সিদ্ধান্তে ধুঁকতে থাকা রেলওয়ের ১০ হাসপাতালে আস্থা ফিরবে কি?

ডা. রত্না দাশ বলেন, ‘নিয়ম হলো পানি দুই দিনের বেশি জমিয়ে না রাখা। কিন্তু বরগুনায় যেহেতু পানির সংকট আছে, তাই জমিয়ে রাখা পানি অর্ধেক ব্যবহার করলেও সেটি তারা ফেলে দেন না। ব্যবহৃত পানির সঙ্গে নতুন পানি ধরে রাখেন। এসব পানি রাখার পাত্রগুলোকে ঢেকেও রাখা হয় না। ফলে এসব পানি ধরে রাখার পাত্রে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নেয় সহজে। যার কারণে ডেঙ্গু এখানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্তরা বাড়িতে মশারি ব্যবহার করছেন না। আরেকটি বিষয়, ঈদের সময় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে। জেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ায় মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।’

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তারের জায়গা নষ্ট করে দিতে হবে যাতে ডেঙ্গু মশা না জন্মায়। সবাইকে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বরগুনায় ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ ডেন-৩ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী ডেন-২ তে আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ১৪ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-২ ও ৩-তে। ৪৩টি অনুমান জিনোম পরীক্ষা করে এই তথ্য মিলেছে।’

আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, ‘বরগুনায় ৪৩টি নমুনা পরীক্ষা করে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২০ জনের শরীরে ডেঙ্গুর ডেন-৩ সেরোটাইপ (৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ) পাওয়া গেছে। এরপর ১৭ জনের শরীরে পাওয়া গেছে ডেন-২ সেরোটাইপ (৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ)। এর বাইরে ৬ জনের নমুনায় ডেন-২ ও ডেন-৩ সেরোটাইপ (১৪ দশমিক শূন্য শতাংশ) তথা কো-ইনফেকশন (সহসংক্রমণ) পাওয়া গেছে। কো-ইনফেকশন বা সহসংক্রমণ প্রতি বছরই কমবেশি পাওয়া যায়। তবে বরগুনার নমুনায় একটিতেও চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।’

BB
সচেতনতা বাড়াতে সাইকেল র‌্যালি। ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘যে হারে ডেঙ্গু আক্রান্ত বাড়ছে, সে হারে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক, নার্স নিশ্চিত করা কঠিন। তাই ডেঙ্গুর উৎসে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’

তিনি জানান, বরগুনায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আটজন চিকিৎসক ও দুইজন বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়।

আইইডিসিআরের ফেলো ডা. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সারাদেশের চার ভাগের এক ভাগ ডেঙ্গু রোগী বরগুনায়। এই জেলায় পানির সংকট রয়েছে। পানি ঢেকে রাখতে হবে এবং পানি রাখার পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। সেইসঙ্গে ঘরে ঘরে সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাসায় বাসায় মশার উৎস, কিছু কিছু ওয়ার্ডে ভয়াবহভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে আক্রান্ত সংখ্যা বেশি।’

তারিকুল ইসলাম লিমন বলেন, ‘ঢাকায় গত বছর পর্যন্ত সেরোটাইপ-২ এর উপস্থিতি বেশি ছিল। এ বছরের উপাত্তটা এখনো হাতে আসেনি। বরগুনায় আমরা ৪৩ নমুনা পরীক্ষা করে সেরোটাইপ-৩ প্রাধান্য বেশি পেয়েছি।’

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে এসে সার্জারি শিখছেন মালয়েশিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক!

সরকারি ফার্মেসি: সম্ভাবনার পাশাপাশি আছে নানা চ্যালেঞ্জও

যখন নতুন কোনো সেরোটাইপের প্রাধান্য তৈরি হয়, তখন ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি হয় বলে মনে করেন আইইডিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুধু রোগের বিস্তার নয়, রোগীর অবস্থাও জটিল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বরগুনায় নতুন একটি সেরোটাইপের প্রাধান্য ওই অঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও সজাগ হওয়া দরকার।’

জানা গেছে, বরগুনায় জুনের ১৬-২২ তারিখ পর্যন্ত সার্ভে পরিচালনা করে আইইডিসিআর। বরগুনায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে বরগুনায় সদরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি, এরপর রয়েছে পাথরঘাটা ও বামনা। বেতাগী ও আমতলী উপজেলায় সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর