জানুয়ারি মাসে বই কিনেছি আড়াই হাজার টাকার। বই কেনার সময় এক হাজার টাকা ধার করা লাগছে। সেই টাকা এখনো শোধ করতে পারি নাই। এরপর আবার ৫০০ টাকা ধার করতে হয়েছে। দিনদিন যেভাবে খরচ বাড়ছে লেখাপড়া শেষ করতে পারব কিনা আল্লাহ জানে। এভাবেই বলছিলেন পীরগাছা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শরীফ শাওন।
রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার প্রত্যন্ত চর এলাকার শিক্ষার্থী শরীফ। তিনি অর্থনীতি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। তবে পড়ার খরচ মেটাতে তার কাজ করতে হয় দোকানে। বিকাল ৪টা থেকে রাত ১-২টা পর্যন্ত মুদি দোকানে বসতে হয়। মাস শেষে হাতে পান ছয় হাজার টাকা। আর দোকানেই মেলে রাতের খাবার। পরীক্ষার ফি বাবদ প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে রাখেন। কিন্তু বাড়িতে টাকা দেওয়ার পর নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
শরীফ আরও বলেন, বাবা কৃষি কাজ করেন। আমাদের জমি যা আছে তা দিয়ে ভাতের জোগাড়ও হয় না। ছোট বোন ক্লাস সেভেনে পড়ে। আমি জানুয়ারিতে বই কিনলাম, আমার আড়াই হাজার টাকা লাগলো। এই বই আগের বছরে কিনতে লাগতো ১৮০০ টাকা। এক বছরে ৭০০ টাকা বেশি লাগলো। ছোট বোনটার জন্য খাতা কলম কিনে দিলাম, অনেকগুলা টাকা খরচ হলো। এভাবে খেয়ে না খেয়ে কতদিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারব জানি না।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস সাধারণ মানুষের। বাজারের ফর্দ ছোট করেও যেন চলছে না। সবকিছুর মতো বেড়েছে শিক্ষা উপকরণের দামও। আবার মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের বাড়ছে মিলরেট বা খাবার খরচও। এমনকি টিউশনিতে ভাটা পড়েছে অনেকের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাগজের দাম বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
অন্যদিকে সারা দেশের অভিভাবকদেরও নাকাল অবস্থা। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি বেশি খারাপ। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার একটি বাজারে স্টেশনারি দোকান চালান প্রাইমারি শিক্ষক মো. বিপুল। তিনি বলেন, আমার এই ব্যবসা প্রায় আট বছরের। বছরের শুরুর দিকে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা বাৎসরিক বাজার করে থাকেন। কিন্তু এবার বিক্রি হয়েছে প্রায় অর্ধেক। তিনি বলেন, এমনকি করোনার সময় যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল তখনও এর চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বিপুল বলেন, শিক্ষার্থীরা বছরের শুরুতে সাধারণ প্রতিটি বিষয়ের একটি করে খাতা কেনে। এছাড়া কলম, জ্যামিতি বক্স, পেন্সিল, রাবার ইত্যাদি। এবছর লক্ষ্য করলাম, শিক্ষার্থীরা খাতা কিনছে তিন-চারটা। সাদা কাগজ আগে যারা চার-পাঁচ দিস্তা কিনত, তারা এখন কিনছে এক-দুই দিস্তা। অনেকেই পুরাতন জ্যামিতি বক্স দিয়েই চালাচ্ছে লেখাপড়া।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। যে খাতা আগে ছিল ৫৫-৬০ টাকা, এখন সেটা বিক্রি করছি ৭৫-৮০ টাকায়। সাধারণ জ্যামিতি বক্সের দাম ছিল আগে ৬০ টাকা, এখন আমার কিনতেই হচ্ছে ৯০ টাকায়।
দেশের সবচেয়ে বড় বইয়ের বাজার নীলক্ষেতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রীতিমতো হাহাকার চলছে ক্রেতাদের মাঝে। এক রিম সাদা কাগজের মূল্য ছিল কয়েক মাস আগে ৩২০ টাকা। এখন কিনতে হচ্ছে ৫০০ টাকায়। সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর বিক্রি হচ্ছে ১,২০০-১,৪০০ টাকায়, আগের দাম ছিল ৭০০-৮০০ টাকা। বাঁধাই করা ৪০ টাকার কাগজের খাতা ৬৫-৭০ টাকা। সাধারণ জ্যামিতি বক্স যেটির দাম ছিল ৬০ টাকা, সেটি এখন ১২০-১৩০ টাকা। কলমের ডজন ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা; পেনসিল ও রং-পেনসিলের দাম গড়ে ৫ টাকা বেড়েছে।
বিসিএস প্রত্যাশীদের পছন্দের একটি বইয়ের দাম গত ডিসেম্বর মাসে ছিল ২২০ টাকা। এখন এটি বিক্রি হচ্ছে ৩১০ টাকায়।
গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বেশি পড়েছে। রংপুর বিভাগের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে ‘রং পেন্সিল’ নামে এক দাতব্য সংস্থা। এর প্রধান উদ্যোক্তা আরমান ইসলাম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের মাঝে সাধ্যমতো খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, জুতা ইত্যাদি দিয়ে থাকি। জানুয়ারি মাসে কুড়িগ্রামের এক প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করছিলাম। তখন দেখি একটা ছোট মেয়ে বাবার কাছে কান্না করছে তার কলম নাই। বাবা মাঠে কাজ করতে করতে বলছেন, আজ টাকা নাই কাল কিনে দেব। মেয়ে কিছুতেই মানবে না। শেষে বাবা বললেন, কলমের দাম তিন টাকা না। মেয়ে কান্না করে বলল, এখন আর তিন টাকায় কলম পাওয়া যায় না, পাঁচ টাকা লাগে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বই পাচ্ছে। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের যা লাগে তা কিনে দেওয়ার মতো সক্ষমতা অনেক অভিভাবকের নাই। আমরা লক্ষ করেছি মূল্যবৃদ্ধির পর অনেক শিক্ষার্থী নীরবেই স্কুল করছে। কারণ সেও জানে তার বাবাকে কিনে দেবার কথা বললে হয়ত স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দেবে।
শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে মেসে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে যারা পরিবার ছেড়ে মেসে থাকেন। তারা বলছেন, তাদের মাসিক খরচ তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই উঠছেন কম ভাড়ার মেসে।
ঢাকায় থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া ইসলাম বলেন, জানুয়ারি মাসে বাসা থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছি। এরপরও মাস শেষে ১ হাজার টাকা নিতে হয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস আগেও আমার ১০ থেকে ১১ হাজার টাকায় ভালোভাবে মাস চলে যেত।
তিনি আরও বলেন, রুম ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা, আনুষঙ্গিক ৫০০ টাকা। এরপর খাওয়ার পেছনে আগে খরচ হতো দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এখন খরচ হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। আগে রিকশা ছাড়া চলতামই না। এখন রিকশায় উঠাও কমিয়ে দিয়েছি। বাধ্য হয়ে মার্চে একটু কম টাকার মেসে উঠব।
রাজধানীর পান্থপথে একটি তিন রুমের ফ্ল্যাটে মেস করে থাকেন শরিফুল ইসলাম। তারা তিন রুমে ১১ জন থাকেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রতি মাসে মিলরেট বাড়ছে। উল্টো খাবার মান কমছে। নভেম্বরে মিলরেট ছিল ৩৯ টাকা, ডিসেম্বরে ৪২ টাকা, জানুয়ারি মাসে হয় ৪৬ টাকা।
আবার শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক টিউশনিতেও ভাটা পড়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আগের মতো টিউশনি পাচ্ছেন না তারা। আগে যেখানে একজন শিশু শিক্ষার্থী দুজনের কাছে পড়ত, এখন সেখানে একজনের কাছে পড়ছে। অনেকেই পড়ছে পরিবারের কোনো সদস্যের কাছে।
সাধারণত জানুয়ারিতে নতুন নতুন টিউশনি পান শিক্ষার্থীরা। রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রুকাইয়া জাহান বলেন, করোনার আগে এত টিউশনির অফার থাকত যে বেছে বেছে পড়াতাম। করোনার পর একটু চাহিদা বাড়ল। কিন্তু এ বছর বেছে পড়াব কি, টিউশনিই পেয়েছি দুটা। অন্য সময় তিন থেকে চারটা টিউশনি থাকত হাতে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি যেভাবে আলোচনায় আসে, শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার বিষয় সেভাবে আলোচনায় আসে না। এভাবে বাড়তে থাকলে শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। এমনকি নিম্নবিত্ত মানুষেরা পড়াশোনা চালাতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
পিএস/জেএম