প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা উজ্জ্বল। এবারের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূতিকাগারও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রথমে সোচ্চার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে অবশ্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই এর সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাবিতেই গড়ে উঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের সংগঠন, যাদের নেতৃত্বে ইতিহাস সৃষ্টিকারী আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখেছে। জুলাই বিপ্লব ছাড়াও জাতীয় নির্বাচন, ট্রান্সজেন্ডার, যৌন নিপীড়ন, শিক্ষকদের পেনশনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ২০২৪ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাবি।
ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে বছরের প্রথম আন্দোলন
বিজ্ঞাপন
ঢাবির ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটি নিয়ে শুরু হয় বছরের প্রথম আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের মতে, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার এক নয়৷ কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে অনড় থাকে। একই সময় চলে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক। সে সময় ছাত্রলীগ হলগুলোতে ব্যাপক সতর্ক অবস্থান নেয়। সবশেষ নির্বাচনে (৭ জানুয়ারি ২০২৪) আবার আওয়ামী লীগ জয়ী হলে কিছুটা স্থিতাবস্থায় আসে ঢাবির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। যদিও বামদল, সাধারণ শিক্ষার্থী, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা নির্বাচনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ জানান। এর মধ্যে যৌন নিপীড়ক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনসহ ছোটখাটো কিছু আন্দোলনও দেখেছে ঢাবি।
অপকর্মে সরব ছিল ছাত্রলীগ
জুলাই আন্দোলন দমাতে নানা অপকর্মের পাশাপাশি বছরের শুরু থেকেই সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ। সংগঠনটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে রমজানের আলোচনা অনুষ্ঠানে হামলাকে কেন্দ্র করে। গণইফতার করে সে সময় এর প্রতিবাদ জানায় সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য সংগঠন। এর কিছুদিন পরেই বুয়েটে ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাব্বিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত ছিল ঢাবি এবং বুয়েট।
বিজ্ঞাপন
বছরের মাঝখানে তীব্র গরমের সময় বাধ্যতামূলক ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম এবং গেস্টরুমের কারণে বেহাল অবস্থায় পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ফ্রি প্যালেস্টাইন ক্যাম্পেইন ও ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি সমাবেশ ও মিছিল হয়৷ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও এক পর্যায়ে এই ইস্যুতে আলোচনায় আসার চেষ্টা করে।
তবে বিগত বছরে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে মরিয়া হয়ে ওঠার মাধ্যমে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরাসরি হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্তাক্ত করে সংগঠনটি। এমনকি নজিরবিহীনভাবে ছাত্রীদের ওপরও হামলা চালায়, যা দেশে-বিদেশে ছাত্রলীগের প্রতি ব্যাপক ঘৃণার জন্ম দেয়।
শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী আন্দোলন
২৬ মে প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনা সরকারের প্রবর্তিত প্রত্যয় স্কিম নিয়ে আপত্তি জানিয়ে মানববন্ধনের আয়োজন করেন ঢাবি শিক্ষকরা। কাছাকাছি সময়ে আন্দোলন করেন কর্মকর্তা কর্মচারীরাও, যা জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। জুলাই মাসে শিক্ষক সমিতির আহ্বানে ও নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকে। একই রকম কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শিক্ষকদের আওয়ামী লীগ সমর্থিত অংশ গণবিরোধী অবস্থান নিলেও বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ও শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকরা আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী এবং গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
ইতিহাসের নতুন মোড় ঘোরানো ছাত্র আন্দোলন
৫ জুন হাইকোর্টের নির্দেশে কোটা পুনর্বহালে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠেন। কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও বিশাল অব্যাহত থাকে। পরে তারা সরকারকে সময় বেঁধে দেন। তবে নির্ধারিত সময়ে সরকার এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেনি। ফলে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন গড়ায় রাজপথে। ‘বাংলা ব্লকেড’সহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন বেগবান হতে থাকে।
শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে পরোক্ষভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে কটাক্য করলে ১৪ জুলাই রাতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। রাতেই মিছিল বের হয় ক্যাম্পাসে। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগ ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করলে আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ১৭ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ সেদিন ছয়জন নিহত হন। আন্দোলন নতুন মোড় নেয়।
ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি হল থেকে ছাত্রলীগকে পিটিয়ে বের করে দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ভাঙচুর চলে তাদের দখলকৃত প্রতিটি রুমে। পাওয়া যায় আপত্তিকর জিনিসপত্র এবং বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ দেশীয় অস্ত্র। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে এক পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে হল থেকে শিক্ষার্থীদের বের হওয়ার নির্দেশ দেয়। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যায়।
একই সঙ্গে ইউজিসির নির্দেশে ঢাবিসহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে রাজপথে গড়ানো আন্দোলন কিছুতেই দমাতে পারেনি সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ জড়িয়ে যায় এই আন্দোলনের সঙ্গে। ১৮ ও ১৯ জুলাই সারাদেশে ব্যাপক সহিংস ঘটনা ঘটে। নিহত হয় কয়েক শ। পরে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিলেও আগস্টের শুরুতে তা আবার বিস্ফোরক আকার ধারণ করে। শিক্ষার্থীরা এক দফা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম সারির বেশির ভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এভাবেই পতন ঘটে প্রায় ১৬ বছরের দুঃশাসনের। ইতিহাসের পাতায় নাম লেখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশ্যে শিবির: নতুন রাজনৈতিক চিন্তা
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে আসেন ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদেক কায়েম। এর একদিন পরেই আত্মপ্রকাশ করেন ঢাবি শিবিরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ। ১১ বছর পর আত্মপ্রকাশ করায় শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন রাজনীতির প্রতি আগ্রহ যেমন দেখা গেছে তেমনি আতঙ্ক ও সমালোচনাও করতে দেখা গেছে কাউকে কাউকে। প্রথম দিকে ছাত্রশিবিরের সাথে ছাত্রদলের খুব বেশি মনোমালিন্য কিংবা আদর্শিক দূরত্বগত বিতর্ক না হলেও ক্রমেই প্রকাশ্যে আসতে থাকে তাদের দ্বন্দ্ব। যদিও তা ছিল কেবলই অনলাইনে।
আরও পড়ুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে ছাত্রশিবির এবং ছাত্রদল যুগপৎভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক। ঢাবিতে প্রায় প্রতিদিনই হতে থাকে সভা-সেমিনার, পাবলিক লেকচার, পলিসি ডায়লগ ইত্যাদি। সেখানে ছাত্রশিবিরকে বেকায়দায় যেমন পড়তে দেখা গেছে, তেমনি শক্ত অবস্থান নিতেও দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রদলের ক্ষেত্রেও। শিক্ষার্থীদের মাঝেও মানসিক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশাব্যঞ্জক দিক হলো গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ ছিল। সংঘর্ষে রূপ নেয়নি কোনো ঘটনাই।
আরএ/জেবি