নানা সমস্যায় জর্জরিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অবস্থার উন্নতি তো নেইই, বরং অবনতি হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। দিন দিন বহিরাগত সমস্যা, ছিনতাই, মাদক ও চোরদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে ঢাবি ক্যাম্পাস। এতে সত্যিকার অর্থেই এটাকে ক্যাম্পাস বলার উপায় নেই বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় যেন একটি উন্মুক্ত মাঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এটাকে একটি পর্যটন স্পট বললেই যেন ভালো মানায়!
প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের ঢাবি ক্যাম্পাসে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। যেখানে সেখানে দেখা মেলে হকারদের। কোথাও নেই কোনো সার্ভেলেন্স বক্স৷ দুই চারটা থাকলেও তা কেবলই নাম কা ওয়াস্তে। ফলে চোর, ছিনতাইকারী অপরাধীদের জন্য প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়তে কোনো বেগই পেতে হয় না।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ঢাবি ক্যাম্পাসে উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের টিকটক জাতীয় ভিডিও বানাতেও দেখা গেছে। নানা অঙ্গভঙ্গি করে ভিডিওর শুটিং হয় দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠে। এ নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
অবাধে বাইরের মানুষ আসায় নোংরা হচ্ছে ক্যাম্পাস। সকালে কিছুটা পরিষ্কার দেখালেও বিকেলে ক্যাম্পাস হয়ে উঠে আবর্জনায় ঠাসা। বিশাল সমাবেশের পর মানুষের ব্যবহার্য টুকিটাকি পড়ে থাকলে যেমন হয় সেই অবস্থা ধারণ করে বিকেলের ক্যাম্পাস। মল চত্বরে এই সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। ব্যবহার্য জিনিসের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত জিনিসও পাওয়া যায়, যা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
বিজ্ঞাপন
রাতের ক্যাম্পাস যেন বিশাল এক হোটেলের রূপ নেয়। বিশেষত মল চত্বর, ফুলার রোড, টিএসসিতে সারি বেঁধে দেখা যায় তরুণ-তরুণীদের আড্ডা দিতে। প্রায়ই প্রকাশ্যেই আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যায় তাদের৷ যা সুস্থ পরিবেশের জন্য সহায়ক নয় বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

ঢাবি ক্যাম্পাসের ভয়ংকর এক জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত এই উদ্যানটি এখন নেশা ছিনতাই ও পতিতাবৃত্তির আঁতুড়ঘর৷ গত বছর ছোট বড় প্রায় ১৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এখানে। যদিও প্রকৃত সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চারদিক থেকে প্রবেশে উন্মুক্ত হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ছে যান চলাচল। এই সমস্যাটি বরাবরই শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ফেরে। বিশেষত টিএসসি, ভিসি চত্বরসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। বেপরোয়া যানবাহন ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
ছিনতাই ও চুরি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে ঢাবি ক্যাম্পাসে। গত রমজান মাসে প্রায় পাঁচটি হলে মোবাইল চুরির ঘটনা ঘটেছে। এক রাতে বঙ্গবন্ধু হল থেকেই দুটি মোবাইল চুরি হয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে চুরি হচ্ছে সাইকেল। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে সাইকেল চুরির ঘটনা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চুরির ঘটনায় কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না প্রক্টোরিয়াল টিম ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান ফয়েজ বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান চুরি, চাঁদাবাজি এবং মাদক সেবনের ঘটনা দ্বারা পরিবেষ্টিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবনতিশীল পরিবেশ একটি উদ্বেগজনক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলকে প্রভাবিত করে না বরং প্রতিষ্ঠানের সুনামকেও কলঙ্কিত করে। শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সংস্কার এবং বর্ধিত নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রেজিয়া আহমেদ সারা বলেন, ‘আমার মতে বহিরাগতদের প্রবেশ সংরক্ষিত করার বিষয়টা খুব সহজ না, তবে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সম্ভব। অনেক আগে থেকেই যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি যান চলাচল বাড়ছে। কিন্তু সেটা যদি কিছু স্পেসিফিক যানবাহনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় সে ক্ষেত্রে শব্দদূষণ এবং যানবাহনের সমস্যা কমতে পারে। আর আমার মতে সেটাই করা উচিত। রিসেন্টলি ভিসি স্যারের ভবনে যে ঘটনাটা ঘটল সেটা তো চাক্ষুস প্রমাণ যে, বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে কিছু একটা করা দরকার।’

এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘সম্পূর্ণভাবে বহিরাগতদের আসা বন্ধ করা তো সম্ভব না, তবে কমানো যেতে পারে। নিয়মটা এরকম হতে পারে, ঢাবির স্টুডেন্টের সাথে গেস্ট হিসেবে যারা ঢুকবে তারাই অনুমতি পাবে। এছাড়া যারা ফটোসেশন বা ফালতু আড্ডাবাজি করতে আসে তাদের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। অন্তত ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার খাতিরে কিছু একটা করা দরকার।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডক্টর মাকসুদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা নতুন সার্ভেইলেন্স সিস্টেম নিয়ে কাজ করছি। অচিরেই সিসিটিভি এবং একটি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। মল চত্বরে এর প্রথম প্রয়োগ দেখা যাবে বলে আশা করা যায়।’
বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মল চত্বরের নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি করা হলে আমরা সেখানে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য জায়গায় এটা সম্ভব হবে না। কারণ এটি একটি উন্মুক্ত জায়গা। আশেপাশে অনেক হাসপাতাল আছে। অনেক স্থাপনা থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়েই বাইরের অনেক মানুষ যাতায়াত করে। এটার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি আমাদের হাতেও নেই।’
প্রতিনিধি/জেবি

