মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

মধুর ক্যান্টিন: নবাবী ড্রয়িং রুম থেকে রাজনীতির আঁতুড়ঘর

আসাদুজ্জামান, ঢাবি
প্রকাশিত: ২৮ মে ২০২৪, ০৫:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

মধুর ক্যান্টিন: নবাবী ড্রয়িং রুম থেকে রাজনীতির আঁতুড়ঘর
রাজনীতির আঁতুরঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিন। ছবি: ঢাকা মেইল

শিক্ষা ও রাজনীতির আঁতুড়ঘর বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কান্টিন। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ সব ঘটনার সাক্ষী এই মধুর ক্যান্টিন। কিন্তু আসলে এই মধুর ক্যান্টিনের ইতিহাসটা কী? আজকের মধুর ক্যান্টিন আসলে কী ছিল? ইতিহাস কিছুটা হলেও এই অনুসন্ধানের দাবি রাখে।

সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান যে এলাকায় সেই এলাকার ইতিহাস গবেষণা করতে গেলে শুরুটা করতে হবে বারো ভূঁইয়াদের সময় থেকে। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বার ভূঁইয়াদের পরাজিত করলে ঢাকা মুঘলদের করায়ত্বে আসে। কিন্তু পরাজিত শক্তি বারো ভূঁইয়াদের ভরণপোষণের জন্য তাদের জমিদারি বহাল রাখা হয়। ঢাকার এই অংশটি পড়েছিল বারো ভূইয়াদের নেতা মুসা খানের হাতে। এখনকার শাহবাগ ছিল তখন  'বাগ এ শাহী' বা রাজবাগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলের কাছে অবস্থিত মুসা খান মসজিদ তারই স্মৃতি বহন করছে। মুঘলদের পতনের পর তা চলে আসে নবাব আব্দুল গনি ও আর্মেনিয়ানদের হাতে। সেখানে এশারত মঞ্জিল নিশাত মঞ্জিলসহ অন্যান্য নবাবী স্থাপনা গড়ে ওঠে। বর্তমান মধুর ক্যান্টিন আসলে এশারাত মঞ্জিলের দরবার গৃহ সোজা বাংলায় ড্রইং রুম।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

মধুদার আত্মত্যাগ

দৃশ্যমান হচ্ছে ঢাবির শতবর্ষী মনুমেন্ট

পরবর্তী ইতিহাস থেকে জানা যায় কীভাবে মধুর ক্যান্টিন  সে সময় মধুদার হাতে এসেছিল। মধুদার পিতামহ ছিলেন নকরী চন্দ্র। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিক্রমপুরের শ্রীনগরের জমিদারদের সাথে নকরী চন্দ্রের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যবসার উন্নতির কথা ভেবে নকরী চন্দ্র সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। এখানে তার ঠিকানা হয় জমিদার বাবুর জিন্দাবাজার লেনের বাসায়। তার দুই ছেলে ছিলেন আদিত্য চন্দ্র ও নিবারণ চন্দ্র। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নকরী চন্দ্রের ব্যবসা প্রসারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার বড় পুত্র আদিত্য চন্দ্রের উপর। তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাবার ব্যবসার প্রসার ঘটানোর। পিতার মৃত্যুর পর আদিত্য চন্দ্র স্থায়ীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ ক্যাম্পাসের চারপাশের এলাকা থেকে ব্যারাক ও ক্যাম্প উচ্ছেদ করা শুরু করে। আদিত্য চন্দ্র তখন ৩০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে দুটি ছনের ঘর কিনে নেন এবং তার একটিতে বসবাস শুরু করেন।

DU2

১৫ বছর বয়সে মধুদা ১৯৩৪-৩৫ সালের দিক থেকেই তার পিতা আদিত্য চন্দ্রের সাথে খাবারের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে পিতা আদিত্য চন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে মধুদা পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন। ব্যবসার কাজ দেখভালের পাশাপাশি তিনি তার বড় ভাই নারায়ণ চন্দ্রের পড়াশোনার খরচ বহন করতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ডাকসুর কার্যক্রম শুরু হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের পাশে মধুদার দায়িত্বে ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকেই শিক্ষা ও রাজনীতির আঁতুড় ঘর হয়ে ওঠে মধুর ক্যান্টিন।


বিজ্ঞাপন


মধুদা স্মৃতি সংসদ প্রকাশনীর উদ্যোগে প্রকাশিত ‘মধুদা: শহীদ মধুসূদন দে স্মারকগ্রন্থ’ বইটি থেকে জানা যায় স্মৃতিচারণমূলক বেশ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের অনেকেই মধুদাকে নিয়ে তাদের স্মৃতির কথা লিখেছেন। বইটির ভূমিকায় বাংলা সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য মধুর ভালবাসা আর অন্যদিকে মধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা- এসব কিছু পাকিস্তানিদের কাছে মধুকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল। ব্যবসায়িক লেনদেনের মাঝে এত চমৎকার স্নেহ আর সম্প্রীতির সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠতে পারে? এখানে অবশ্যই সন্দেহজনক কিছু চলছে। মধুর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্বই যে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসার কারণ হয়ে উঠেছিল এসব কিছুই শত্রুদের বোধগম্যতায় আসে নি।’

আরও পড়ুন

ঢাবিতে আসন কমলে সংকটের সমাধান মিলবে?

ঢাবির সিনেট সদস্য মনোনীত হলেন ৫ এমপি

তবে মধুদার দুঃখজনক জীবনাবসান হয় ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে। পাকিস্তানি বাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় মধুদাকে।

DU3

মধুদার ছেলে অরুণ কুমার দে বর্তমানে ক্যান্টিনের দায়িত্বে আছেন। তার ভাষ্যমতে, সেই রাতে তার বাবা অর্থাৎ মধুদার হাতে প্রথম গুলি লাগার পরই এই দৃশ্য দেখে তার মা মারা যান। একই রাতে আরও মারা যান মধুদার সদ্য বিবাহিত পুত্র রণজিৎ কুমার এবং তার স্ত্রী রিনা রানী। আরও জানা যায়, পাকিস্তানিরা গুলিবিদ্ধ করে জীবিত অবস্থায়ই মধুদাকে মাটিতে পুঁতে ফেলে।

এখনো যেকোনো ছাত্ররাজনীতি সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মধুর ক্যান্টিনের এই টেবিলগুলো থেকেই। নবাবদের দরবারে গৃহের সিদ্ধান্তই হোক আর বাংলার জনতার জন্য যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসতে থাকে এই ঐতিহাসিক চার দেয়ালের মধুর ক্যান্টিন থেকে। যুগ যুগ ধরে মধুর ক্যান্টিন নানা ধারার নানা মতের নানা পথের ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্মেলন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে-এই প্রত্যাশা সবার।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর