শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ব্যাংকে তারল্য সংকটে বিপর্যয়ের মুখে পোশাক খাত

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:২০ এএম

শেয়ার করুন:

ব্যাংকে তারল্য সংকটে বিপর্যয়ের মুখে পোশাক খাত
  • রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক থেকে
  • দুর্বল ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে
  • ব্যাংকিং জটিলতায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকরা
  • পোশাক কারখানা রুগ্ন শিল্পে পরিণত হওয়ার শঙ্কা
  • প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারে, কর্ম হারাবে লাখো শ্রমিক 
  • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে

দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প বর্তমানে বড় ধরনের আর্থিক চাপে রয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের তীব্র তারল্য সংকটে পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো তাদের প্রাপ্য রফতানি আয়ের অর্থ পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো নতুন লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলাতেও ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে শিল্প খাতে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। এতে কারখানাগুলো উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধসহ নিয়মিত ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট শুধু পোশাক শিল্প নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যই উদ্বেগজনক। রফতানি আয় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, ঋণখেলাপি এবং অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনই জরুরি প্রণোদনা প্যাকেজ বা বিশেষ তহবিল গঠন করে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সাময়িকভাবে কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠন, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং আর্থিক খাতে সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি।

বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রফতানিতে ৩৯.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। যা দেশের সামষ্টিক রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে ব্যাংকিং জটিলতার কারণে রফতানি আয় নগদায়ন করতে না পারলে পোশাক খাত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এতে উদ্বিগ্ন শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচরের কারণে বেশ কিছু ব্যাংক কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। আর এসব ব্যাংকে রফতানি আয়ের অর্থ দেশে ফেরত এলেও তা সময়মতো রফতানিকারকদের পরিশোধ করতে পারছে না। এর ফলে উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদানে দেরি হওয়ায় কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে পোশাক খাত থেকে। এই খাতে দীর্ঘমেয়াদী সংকট অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে। তাই শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, সরকারেরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে বিশেষ নীতি সহায়তা, কর ছাড় এবং প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে রফতানিকারকদের আর্থিক সংকট লাঘব করতে হবে।


বিজ্ঞাপন


9

শিল্প মালিকরা মনে করছেন, সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় সময়মতো রফতানি আয় না পাওয়া, উৎপাদন ও সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা- সব মিলিয়ে দেশের পোশাক শিল্প ভয়াবহ চাপের মুখে পড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্প যে ঝুঁকিতে আছে, তা আর অবহেলার সুযোগ নেই। ব্যাংক খাতের সংকট, সুশাসনের অভাব ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা দ্রুত সমাধান করা না গেলে এর প্রভাব পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, কর্মসংস্থান এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বিজিএমইএর জরুরি অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ এখন দেশের রফতানি খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার শেষ সুযোগ হতে পারে।

দেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, দুর্নীতি, মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সংকটে রয়েছে। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, স্বতন্ত্রভাবে এগুলোর টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের পাঁচটি বেসরকারি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে একটি বৃহৎ, শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামি ব্যাংক গঠন করা হবে। ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, সোশ্যাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক।

এমন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ও শিল্প মালিকরা। দুর্বল ও আর্থিক সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর বিষয়ে ইতোমধ্যে কথাও বলেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্যবসায়ী নেতারা তাদের অসহায়ত্বের কথা বলেন। গভর্নরও তাদের আশ্বস্ত করেছেন। ব্যবসায়ী নেতারা সংকটাপন্ন পাঁচটি ব্যাংকের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন। উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে না পারলে বায়াররা চলে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে কিংবা রফতানির আদেশ স্থগিত করলে প্রভাব পড়বে আমাদের শ্রম বাজারেও। এতে কর্মহীন হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক।

দুর্বল এসব ব্যাংকের বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, দেশের ১২ থেকে ১৩টি ব্যাংক লুটপাটের শিকার হওয়ায় এগুলো পুনরুদ্ধার করা এবং আমানতকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

গভর্নর বলেন, সাময়িকভাবে ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের প্রাপ্য টাকা পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে রফতানিকারকদের জরুরি আর্থিক চাহিদা মেটানো যায়। পরবর্তী সময়ে সমস্যাটির একটি স্থায়ী ও চূড়ান্ত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

8

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান ঢাকা মেইলকে বলেন, রফতানি আয়ের অর্থ দেশে ফেরত এলেও কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক তা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। এর ফলে উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদানে দেরি হওয়ায় কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বাড়ছে।

বিজিএমইএ’র এই নেতারা সতর্ক করে বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অনেক পোশাক কারখানা রুগ্ন শিল্পে পরিণত হবে। এর প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারে, লাখো শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাতে পারেন। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট হতে পারে, যা দেশের প্রধান রফতানি খাতের জন্য মোটেও শুভ নয়।

ব্যাংক খাতের সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যাংকখাত সংস্কারে সরকারের উদ্যোগ দেখা গেলেও বছর শেষে দৃষ্টান্তমূলক কিছু হয়নি। কিছু ব্যাংকের প্রশাসনিক পরিবর্তন ও দুর্বল ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা চালানো হলেও সরকার ব্যাংক পুনরুদ্ধারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। সামনের সময়গুলোতে কতটুকু করতে পারবে তাও দেখার বিষয়।

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর