*২০২৫-২৬ অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ হাজার কোটি টাকা
*সিআইবি ছাড়াই আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ বিতরণ
*দালাল-খেলাপি চক্রের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা
কৃষি ঋণ বিতরণের নীতিমালা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য যাচাই ছাড়াই মাইক্রো ফাইনান্স ইনস্টিটিউটগুলো (এমএফআই) সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণের সুযোগ পাওয়ায় এ বিতর্ক ঘনীভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিধান সংঘবদ্ধ খেলাপিদের ঋণ হাতিয়ে নেওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হতে পারেন এবং ঋণ আদায় প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনকি ঋণের অর্থ পাচার হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ঘোষিত কৃষি ঋণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাইক্রোক্রেডিট ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ দেওয়া যাবে সিআইবির তথ্য যাচাই ছাড়াই। ব্যাংকগুলো নিজেদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করবে, আর বাকি অংশ বিতরণ করবে এমএফআই। কিন্তু সিআইবির ডাটাবেসে এমএফআইয়ের তথ্য নেই। ফলে খেলাপিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে একাধিকবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে প্রকৃত কৃষক ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায়ে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষিঋণ ঘোষণার সময় গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কৃষকদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে দালালমুক্ত ব্যবস্থার বিকল্প নেই। দেশের অধিকাংশ কৃষকের ঋণে প্রবেশাধিকার সীমিত। ফলে ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা কৃষি ঋণ কতটা প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছায়, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম এই প্রবণতাকে সতর্কসংকেত আখ্যা দিয়ে বলেন, বন্যা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য এখন বেশি ঋণ প্রয়োজন। কৃষি খাতে ব্যাংক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে, বাজারে সরবরাহ সংকুচিত হবে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। এতে কৃষকরা কৃষি ছেড়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হবেন, যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।
অতীতেও আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত কৃষি ও পল্লী ঋণে সিআইবি যাচাই শিথিল করা হয়েছিল। তবে গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কৃষি ঋণে সিআইবি রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করে। এমআরএর তথ্য বলছে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ হয়েছে, যার কোনোটিই সিআইবি রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এতে অনেক খেলাপি নতুন ঋণ নিয়েছেন এবং অনেকেই তা পাচার করেছেন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, সিআইবি ডাটাবেজ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ট্রানজিশনাল সময়ে খেলাপিরা ঋণ নিলেও তা পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে এমএফআইগুলো নিজেদের মতো করে ঋণ মনিটরিং করার চেষ্টা করছে যাতে অর্থ অন্য কাজে বা পাচারে ব্যবহৃত না হয়।
>> আরও পড়তে পারেন
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সিআইবি রিপোর্ট যাচাই ছাড়া ঋণ দেওয়া হলে কোনো গ্রাহক একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিলেও তা ধরা সম্ভব হবে না। গাজীপুরের কালীগঞ্জের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি ঋণ নিতে দালাল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারস্থ হতে হয়। এতে ঘুষের কারণে খরচ বেড়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত কৃষক সময়মতো ঋণ পেলেও এখন অনেক খেলাপি ঋণ পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ছোট কৃষকদের ঋণ সুবিধা বাড়াতে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণে সিআইবি চার্জ শিথিল করা হয়েছে। তবে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এমআরএর সিআইবি ডাটাবেজ না থাকায় খেলাপিদের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমএফআইগুলোর আরও সতর্কভাবে ঋণ বিতরণ করা উচিত।
টিএই/এএস

