শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ভারতীয় পণ্যে শুল্ক বাড়ায় সংকটেও আশাবাদী ব্যবসায়ীরা

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫০ এএম

শেয়ার করুন:

ভারতীয় পণ্যে শুল্ক বাড়ায় সংকটেও আশাবাদী ব্যবসায়ীরা

নতুন অর্ডারের প্রত্যাশায় উৎপাদনকারীরা
পোশাকসহ বহুমুখী পণ্য রফতানির সুযোগ 
সক্ষমতা না বাড়লে আশাহত হওয়ার শঙ্কা
ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার আশ্বাস সরকারের


ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ বড় সুযোগ দেখতে পাচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর গড়ে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়। ফলে ভারতীয় পণ্যের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুযোগ লুফে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এতে রফতানি বাজার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। 


বিজ্ঞাপন


ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, উচ্চ শুল্কারোপে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়া, জুতা, হস্তশিল্প ও হালকা প্রকৌশলপণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্টস খাত, যা বাংলাদেশের প্রধান রফতানি নির্ভর খাত, সেখানে বড় ধরনের অর্ডার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বড় রফতানি গন্তব্য। সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক যুক্ত হওয়ায় দেশটির আমদানিকারকরা বাংলাদেশমুখী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে উৎপাদন সক্ষমতা ও মান নিয়ন্ত্রণে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে।

অন্যদিকে সরকারও ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি বাড়াতে শিগগিরই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ কৌশল গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ব্যাংক ঋণ, কর ছাড় ও বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগের কথাও ভাবছে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চশুল্কের প্রভাবে ভারতীয় রফতানিকারকেরা কিছু পণ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবেন। এছাড়া খরচ বাড়ায় গুণগত মানও ঠিক রাখতে পারবে না দেশটি। ফলে যেখানে বাংলাদেশের সমজাতীয় নানা পণ্য সুবিধা পাবে।

রফতানিকারকেরা বলছেন, ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্কায়নের পর বিদেশি অনেক বায়ার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশকে শুধু পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ না থেকে বহুমুখী পণ্য রফতানির সুযোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য এবং কৃষিজাত প্রক্রিয়াজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সম্ভাবনাময় হতে পারে।

উৎপাদনকারীরা ইতোমধ্যে নতুন অর্ডারের প্রত্যাশায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। অনেক কারখানায় উৎপাদন লাইন সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি আসবে। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, মান বজায় রাখা, সময়মতো সরবরাহ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উৎপাদন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সার্বিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এখন এই সুযোগকে বাস্তব রূপ দিতে হলে ব্যবসায়ী ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা সবচেয়ে জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি গন্তব্যগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত থেকে দেশটি প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হওয়ায় দেশটির ক্রেতারা তুলনামূলক সস্তা বিকল্পের খোঁজ করবেন। সেই জায়গায় বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অন্যতম গন্তব্য।

বিজিএমইএ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্ডার বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো। গুণগত মান বজায় রাখতে না পারলে এই সুযোগ দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

প্রস্তুত হচ্ছে উৎপাদন খাত
রফতানি সম্ভাবনা বৃদ্ধির খবরে দেশের অনেক কারখানাই ইতোমধ্যে উৎপাদন লাইন সম্প্রসারণে কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে পোশাক ও হোম টেক্সটাইল খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। অনেক প্রতিষ্ঠান অর্ডার বাড়ার আশায় অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ এবং উৎপাদন সরঞ্জাম আপডেটের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এছাড়া, চামড়া, জুতা, হস্তশিল্প ও হালকা প্রকৌশল খাতের উদ্যোক্তারাও সুযোগ নিতে আগ্রহী। তাদের মতে, ভারতীয় পণ্যের শুল্ক বাড়ায় শুধু পোশাক নয়, বহুমুখী পণ্য রফতানিতেও বাংলাদেশের সুযোগ তৈরি হবে।

সরকারও ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার কথা জানিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা করা হবে। এ পরিকল্পনায় থাকবে- ব্যাংক ঋণে বিশেষ সুবিধা, কর ছাড়ের সুযোগ, বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন, কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়।

বহুমুখী রফতানির সুযোগ
বাংলাদেশকে শুধু তৈরি পোশাক খাতে সীমাবদ্ধ না রেখে বহুমুখী রফতানির ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি, প্লাস্টিক, পাদুকা, ভেবারেজ, ফার্মাসিউটিক্যালস, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিজাত প্রক্রিয়াজাত পণ্য, এমনকি সিরামিকস খাতেও যুক্তরাষ্ট্রে ভালো সম্ভাবনা আছে। শুল্ক সুবিধা থাকায় এই খাতগুলোতেও রফতানি বাড়ানো সম্ভব হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশুল্ক বাংলাদেশকে রফতানি বাড়ানোর একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং সরকারও সহযোগিতার পরিকল্পনা করছে। তবে সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ব্যবসায়ী ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ, মান নিয়ন্ত্রণ ও বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়াই হবে মূল শর্ত। তাদের মতে, এই সুযোগ বাংলাদেশের জন্য শুধু অস্থায়ী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নয়, বরং রফতানি খাতকে আরও শক্তিশালী করার নতুন এক মাইলফলক হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যপণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান পারটেক্স গ্রুপের ড্যানিশ ফুডের ম্যানেজার আদনান ইবনে নূর জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ার পর থেকে আমাদের অনেকে নক করেছে। আমরাও তাদের সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের কাছে তুলনামূলক কম পেয়ে অর্ডার করতে তারা রাজি হচ্ছে। 

বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, আসলে প্রতিযোগী কমলে সুবিধা বাড়বে এটা স্বাভাবিক। আমরাও চাই সুযোগকে লুফে নিতে। তবে এই সুযোগ কত দিন থাকবে সেটা এখনই বলা যাবে না। তবে আমাদের পণ্যের গুণগত মান ঠিক রেখেই কাজ করতে হবে। 

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, এটি আমাদের জন্য বিরাট সুযোগ। আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এগোচ্ছি। বাজার সম্প্রসারণে আমাদের যা যা করা দরকার তাই করবো। এখনই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে বায়াররা অন্য কোথাও চলে যাবে। 

নিট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঢাকা মেইলকে বলেন, ভারতের কিছু অর্ডার বাংলাদেশে আসবে এটা ঠিক। তবে আমাদের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) কতটুকু আছে সেটাও দেখতে হবে। আমরা বর্তমানে চাহিদার ৩০ শতাংশ ঘাটতিতে আছি। গ্যাস সংকট, এলসি জটিলতায় আমরা পুরো কভার করতে পারি না। এর মধ্যে আরও যদি ৩০ শতাংশ অর্ডার বাড়ে তাহলে আমরা তো দিতে পারবো না।

তবে তার মতে, অর্ডার বাড়বে কি-না সেটা নির্ভর করবে সরকারের ওপর। সরকার জ্বালানি সাপোর্ট ও ব্যাংকিং সহায়তা দিলে অর্ডার বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। 

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর