সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫, ঢাকা

‘লুটপাট’ কমলেও ব্যাংক মালিকদের ‘পেটেই’ ঋণের পৌনে দুই লাখ কোটি

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০২৫, ১২:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

‘লুটপাট’ কমলেও ব্যাংক মালিকদের ‘পেটেই’ ঋণের পৌনে দুই লাখ কোটি

* ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার
* আগে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি
* পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ঋণ নেন ব্যাংক মালিকরা

দেশের ব্যাংকখাতে বেগতিক খেলাপি ঋণ। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। তবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক মালিক তথা পরিচালকদের দখলে ছিল। যা তারা একজন আরেকজনের সাথে সমোঝতার মাধ্যমে দিয়েছেন। যদিও আগের থেকে এর পরিমাণ বেশ কমেছে। তারপরও পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার ঋণ পরিচালকদের কাছে থাকায় সেটা লুটাপাটের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


বিজ্ঞাপন


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, পতিত সরকারের সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সমন্বিতভাবে ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছিলেন। গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পরিবর্তনের পর বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন হওয়ায় মাত্র ৪ মাসে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সেই ঋণ কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটিতে।

9

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে এতো বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে খেলাপির পেছনে মূলত পরিচালকদের মধ্যে সমঝোতা ও আইনগত দুর্বলতা দায়ী। নিজেদের ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নেওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকলেও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে সমন্বয় করে একে অপরের ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ আদায় করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই পরিচালকেরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে সুবিধা নিয়েছেন। আইন সংশোধন ছাড়া এ ধরনের অপব্যবহার বন্ধ হবে না।


বিজ্ঞাপন


ব্যাংক লুটপাটের সাম্রাজ্য ও মূল হোতা

ব্যাংক খাতে যেসব গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম এস আলম, বেক্সিমকো ও নাসা গ্রুপ। এস আলম গ্রুপ ব্যাংক দখল করে পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিরাট ঋণ আদায় করে। বেক্সিমকো চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারও ছিলেন এ লুটপাটের নেতৃত্বে।

২০১৬ সালে ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। এস আলমের উত্থানের পর মাত্র ৮ বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার কোটিতে—প্রায় ১৬০ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধি।

২০২৪ সালের আগস্টে সরকারের পতনের পর প্রায় ১১টি প্রভাবশালী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। এর ফলে শুধু চার মাসে পরিচালকদের ঋণ কমে ৬০ হাজার কোটি টাকার নিচে নামে। তবে অনেকেই শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকে যাওয়ায় তাদের নেওয়া ঋণ ব্যাংক মালিকদের দখলেই রয়ে গেছে।

10

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, ৮টি ব্যাংকের পরিচালকেরা মোট পরিশোধিত মূলধন দিয়েছেন ২,৪০০ কোটি টাকা, অথচ তারা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার কোটি টাকা-মূলধনের ৫ শতাংশ মাত্র। এটাই দুর্নীতির আসল প্রতিচ্ছবি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, একজন পরিচালক তার নিজ ব্যাংক থেকে পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবেন না। কিন্তু সেই আইন উপেক্ষা করে সমন্বিত কৌশলে গ্রুপভিত্তিক ঋণ লুটের মহোৎসব চলে আসে।

যদিও ব্যাংক পর্ষদে পরিবর্তনের ফলে পরিচালকদের ঋণ কিছুটা কমেছে, কিন্তু শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, শেয়ারহোল্ডারদের দেওয়া গোপন ঋণসহ প্রকৃত পরিচালক ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

বিভিন্ন ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা বা ঋণ দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে ছিল এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকের থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় অবস্থানে নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রনাধীন এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ। তৃতীয় স্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নেয় ১০ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রপের পরিচালকরা নেয় ১০ হাজার কোটি। এছাড়া সাইথইস্ট ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আগস্টের আগে ব্যাংক খাতে যা ঘটেছে তা সবার জানা। আমরা এখন ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন সংস্কারে কাজ করছি।

টিএই/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর