রোববার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত যমুনা পাড়ের মাঝিরা

পারভীন লুনা
প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২৩, ০৫:৩৮ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

ক্ষণে ক্ষণে রুপ বদলায় চর। কখনো ধু-ধু বালিতে মরুভূমির অনুভব কখনো আবার অথৈ পানিতে সাগরের দৃশ্য। পরিস্থিতি  যখন যাই থাক না কেন, চরের মানুষ সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই টিকে থাকে। টিকে আছে। প্রকৃতিতে আষাঢ় আগত। আর কিছুদিন পরই বর্ষার চিরচেনা চেহারা হয়ত দেখা যাবে। অতিবৃষ্টি, পাহাড়ী ঢল। সব মিলে যমুনায় নতুন যৌবনের দেখা মিলবে। যদিও বর্ষা আসার আগেই নদীতে নতুন পানি চলে এসেছে। এজন্যই মাঝিরা বর্ষাকালের একমাত্র বাহন নৌকা মেরামত আর নতুন নৌকা তৈরিতে বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

যমুনা নদীতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পারাপার হন। যমুনা বেষ্টিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলা। এর মধ্যে সারিয়াকান্দির সিংহভাগ ও ধুনটের একটি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বহমান যমুনা। তবে যমুনা এখন শান্ত। তার বিশাল জলধারা এখন অনেকটাই ফাঁকা। জলের জায়গা দখল করে জায়গা করে নিয়েছে বালুচর।


বিজ্ঞাপন


যমুনার এই বিশাল জলাধার পাড়ি দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌকা। পাল তুলে সঙ্গে দড়ি বেঁধে মাঝি-মাল্লারা নৌকা বেয়ে নিয়ে যায় নদীর কূল ঘেঁষে। বর্তমানের চিত্র অবশ্য ভিন্ন। এখন সেই জায়গায় স্হান করে নিয়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। আগের নৌকাগুলোও এখনো চলে যমুনায়।

নৌকা মেরামতের এখন উপযুক্ত সময়। নতুন করেও অনেকে তৈরি করছেন যমুনায় চলাচলের এই বাহনটি। যমুনা শুকানো চরেই নৌকা তৈরি করছেন কারিগররা।

হাট শেরপুর চরের রফিক তাদেরই একজন। বহুকাল ধরে নৌকা মেরামত ও নতুন নৌকা তৈরির কাজ করে থাকেন। রফিকের বাবাও নৌকার কারিগর ছিলেন। এটা রফিকের আদি পেশা।

রফিক বলেন, একসময় ছোট ডিঙি নৌকা বেশি ব্যবহার হতো। এখন মানুষের প্রয়োজনে বড় বড় নৌকা তৈরি হচ্ছে। নৌকা তৈরিতে বিশেষ কোনো কাঠ ব্যবহার হয় না। তবে সাধারণত নৌকার ক্ষেত্রে রোড কড়ই, হিজল, মেহগনি কাঠ বেশি ব্যবহার হয়। কেউ কেউ ছোট নৌকা তৈরির ক্ষেত্রে কাঁঠালের কাঠও ব্যবহার করে থাকেন। নৌকা তৈরিতে আলকাতরা, তারকাঁটা, গজাল, পাতাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ৪ থেকে ৫ জন শ্রমিক লাগে একটি ডিঙি নৌকা তৈরি করতে। ১২ হাতের নৌকা তৈরিতে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ পড়ে।


বিজ্ঞাপন


jamuna boat

তিনি জানান, রকমভেদে নৌকা তৈরিতে খরচ পড়ে দশ হাজার থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। এরই মধ্যে যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে পানি আসতে শুরু করেছে। সেজন্য নদীর পাড়ের মানুষ নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ১০ হাত লম্বা থেকে ৭০ হাত পর্যন্ত লম্বা নৌকা তৈরি করছেন এ এলাকার বাসিন্দারা।

কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের ইন্দুর মারা চরের বাসিন্দা পলাশ জনান, তিনি এবার ২৪ হাত লম্বা একটি নৌকা তৈরি করেছেন। উপজেলার অনেকেই নতুন নৌকা তৈরি করছে বর্ষায় ব্যবহারের জন্য।

তানা জানান, নৌকা তৈরিতে খরচ কম। তৈরি করা নৌকা কিনতে গেলে দাম বেশি পড়ে। সে কারণে বগুড়ার মাঝিরা নৌকা তৈরি করে নেন।

বগুড়া সারিয়াকান্দির বড়ইকান্দি গ্রামের কারিগর  শরিফ জানান, মাসে তিনি ১৫টি নৌকা তৈরি করেন। ১টি নৌকা তৈরি করে তিনি পান ৫০০ টাকা। টিপু সুলতান নামের আরেক কারিগর বলেন ১টি নৌকা তৈরি কারতে ৩ দিন সময় লাগে। প্রতিদিন তিনি ৩০০ টাকা করে মজুরি পান।

কুতুবপুর চরের নৌকার মাঝি বসির আলী জানান, যমুনায় ধীরে ধীরে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। বর্ষা মৌসুম এলে এ এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। সেসময় নৌকার চাহিদা দ্বিগুণ হয়। প্রতিবছর শতাধিক নৌকা মেরামত হয়, আবার শতাধিক নৌকা নতুন করে তৈরি করা হয়। নতুন নৌকা দিয়ে বেশিরভাগ সময় শুধু যাত্রী পারাপার করা হয়ে থাকে।

বসির বলেন, আমার বেশ কয়েকটি গরু এবং  ছাগল আছে। প্রতিদিন আমার নৌকায় চরে যেতে হয় ঘাস আনতে। পুরানো হয়ে যাওয়া নৌকা তাই বন্যা আসার আগেই মেরামত করে নেওয়া হচ্ছে। আমরা চরের মানুষ, নৌকায় আমাদের বন্যার সময় একমাত্র ভরসা। আমরা নৌকায় চরে এ গ্রাম থেকে ওই গ্রামে, হাটে বাজারে যাই। আমাদের ছেলে মেয়েরাও স্কুলে যায় এই নৌকা করেই।

সারিয়াকান্দি কর্নিবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন দীপন জানান, বর্ষা মৌসুমকে ঘিরে প্রতিবছর সারিয়াকান্দি নদীর পাড়ের মানুষ নৌকা তৈরি করেন। আবার পুরনো নৌকা মেরামত করে থাকেন।যেখানে পারাপারের মাধ্যম নৌকা। মাছ ধরার কাজেও ব্যবহৃত হয় এই বাহনটি। সবমিলে যমুনা পাড়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম এই নৌকা।

তিনি জানান, যাত্রী পারাপার হতে ভালো মানের নৌকা হলে আয় রোজগার ভালো হয় বলে মাঝিরা নিজ দায়িত্ব থেকে সেটা করে থাকেন। আর আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছে যমুনা নদীতে সব সময় ভালো মানের নৌকা নামাতে হবে, যেন দুর্ঘটনা না ঘটে। ভালো নৌকা না হলে নদীতে নামানো নিষেধ রয়েছে। দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে মাঝিদের বলা হয়েছে।

/একে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন