কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রাম। যা এখন ইউটিউব ভিলেজ নামে পরিচিত। এই গ্রামের দুইজন যুবকের নেতৃত্বে শুধু মাত্র ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেকে। সেই সাথে তারা সবসময়ই পাশে দাঁড়াচ্ছেন এলাকার প্রতিবন্ধী এবং অসহায় মানুষের পাশে। প্রথম দিকে শখের বসে এটি শুরু করলেও এখন তা অনেকের আইকনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত শিমুলিয়া গ্রামটিই এখন ইউটিউব ভিলেজ।
জানা যায়, ২০১৬ সালের দিকে ওই গ্রামের ছেলে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার লিটন আলী ইউটিউবে আপলোড করার জন্য প্রথম এলাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না করে সেটির ভিডিওধারণ করেন। এই কাজে এলাকাবাসীর ব্যাপক উৎসাহ এবং ইউটিউবে দর্শকদের চাহিদা পাওয়ায় তিনি নিয়মিতভাবে এই কাজ শুরু করেন।
আরও পড়ুন: রাজশাহীর ‘ব্রেকআপ টেবিলে’ যত কারবার
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে সপ্তাহে দুইদিন আয়োজন করে করা হয় রান্না বান্না। এবং এই গ্রামের পাশাপাশি আশেপাসের কয়েক গ্রামের লোকজনেকে বিনামূল্যে সেই খাবার খাওয়ানো হয়। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার করা হয় এই রান্নার আয়োজন।
এখন গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গ্রামে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যও আলাদাভাবে রান্না করা হয়। রান্না করা খাবার প্যাকেট করে পাঠানো হয় সেইসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তিদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য সপ্তাহে দুইদিন হলেও তাদের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দেওয়া।
এইসব কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রামে অনেক তরুণের কাছে লিটন আলী এখন আদর্শ। পেশায় তিনি সফটওয়্যার প্রকৌশলী। পড়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট)। রাজধানীর মিরপুরে এক মামার সঙ্গে তার যৌথ মালিকানার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও আছে।
জানতে চাইলে লিটন আলী বলেন, প্রথমের দিকে শখের বসে ইউটিউব চ্যানেল চালু করলেও পরবর্তী সময়ে আয়ের বিষয়টি মাথায় আসে। এখান থেকে আয় শুরু হওয়ার পর থেকে কাছের মানুষদের জন্য কিছু করার দরকার বলে মনে করি। ব্যাবসার কাজে বেশির ভাগ সময় ঢাকায় সময় দেওয়ার কারণে এই কর্মকাণ্ডের হাল ধরেন লিটনের মামা দেলওয়ার হোসেন। এলাকায় তিনি ‘দেলোয়ার মাস্টার’ নামে পরিচিত। শুরুতে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আলোজন করা হয় রান্নার। অল্প কিছু মানুষকে সেই খাবার খাওয়ানো হতো। সেই রান্না খাবারের ভিডিও ধারণ করে আপলোড করা হতো ইউটিউবে। এতে করে এলাকার মানুষের কাছে রান্না খাবারের বিষয়টি যেমন জনপ্রিয়তা পায়, তেমনি ভিডিওগুলোও ভাইরাল হতে থাকে। শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামীণ জীবনের এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়ে যায়।
বিদেশি রান্নাবিষয়ক জনপ্রিয় অনেক ফেসবুক পেজে শেয়ার হয় ভিডিওগুলো। সেই ভিডিও চোখে পড়ে বেস্ট এভার ফুড রিভিউ শো চ্যানেলের সানি সাইড এর। তিনি নিজের চোখে এই কার্মকাণ্ড দেখার জন্য ছুটে আসেন এই গ্রামে। তারপরে থেকেই এই গ্রামটি ইউটিউব গ্রাম নামে পরিচিতি পায়।
আরও পড়ুন: নতুন আলোয় নৈসর্গিক আলুটিলা
বিজ্ঞাপন
লিটন বলেন, শিমুলিয়া এখন অনেকের কাছেই ইউটিউব গ্রাম নামে পরিচিত। প্রথমত কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া শুরু করলেও এখন সব কিছুই গুছিয়ে করা হয়। আরও কয়েকটি চ্যানেল খোলার চিন্তা আছে, সেখানে আরও মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে তিনি আসা প্রকাশ করেন। এখন যা করা করা হচ্ছে তা মূলত চ্যানেলের আয় থেকে। এ আয় থেকেই রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা, চারজন ভিডিওগ্রাফার, রাঁধুনিসহ প্রায় ৫০ জন মানুষের বেতন ও সম্মানীর ব্যবস্থা হয়ে যায়।
শিমুলিয়া গ্রামে এখন এই ইউটিউবের আয় থেকে করা হচ্ছে ইউটিউব পার্ক। গ্রামে গিয়ে দেখা যায় লিটন আলীর মামা দেলোয়ারের ব্যাক্তিগত ৩৫ বিঘা জমিতে পুরোদমে চলছে পার্ক উন্নয়নের কাজ। পার্কের ঢোকার পথেই চোখে পড়ে বাঁশ দিয়ে বাতা তৈরী গ্রামীণ ঐতিহ্যের বাহন গরুর গাড়ি। তৈরী করা হচ্ছে নারকেলের আকৃতির ঘর, লাভ আকৃতির বসার স্থান, বাঁশ ও খড় দিয়ে ব্যাঙয়ের দৃষ্টিনন্দন ছাতা, ছোট ব্রিজ, দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য পুকুরের মাঝে গোল ঘর ইত্যাদি।
গ্রামের উন্নয়নের জন্য ও নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন লিটন আলী এবং দেলওয়ার। শিমুলিয়া গ্রামের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যাক্তি শাহিন আলী মন্ডল। তার থাকার জন্য কোনো ঘর ছিল না, বিষয়টি নজরে আসার পরে দেলওয়ার হোসেন শাহিন আলীকে একটি দুই কক্ষ বিশিষ্ট টিনের ঘর করে দেন।
এ বিষয়ে শাহীন আলীর পিতা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে হাতে পায়ে শক্তি পায় না। তাই কোনো কাজ করতে পারে না। ছেলের থাকার জন্য আলাদা কোনো ঘরও ছিল না। বিষয়টি জানার পর দেলোয়ার মাস্টার তাকে একটি ঘর তুলে দিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া আমি দেলওয়ার মাস্টারের পার্কে কাজ করি। সেখান থেকে যা আয় হয় আমাদের সংসার চলে যায়। গ্রামে বসে এই ভাবে খুব সহজে কাজ পাওয়ায় খুশি সাইফুল ইসলাম।
ওয়াজ আলী নামের এক ব্যাক্তি বলেন, আমরা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এখানে কাজ করি। পুকুরের মাঝে বসার জন্য আমরা বাঁশ দিয়ে একটা ঘর তৈরি করছি। যাতে সেখানে দর্শনার্থীরা এসে দেখতে ও বসতে পারে। আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করি। এখান থেকে যে টাকা দেয় তা দিয়ে মোটামুটি আমাদের সবার সংসার চলে যায়।
আরও পড়ুন: বাঁশ কাবাব ও বাঁশপাতার চা বিক্রি হচ্ছে যশোরে
ইউটিউব চ্যানেলসহ পার্ক এবং সকল কর্মকাণ্ড বর্তমানে পরিচালনা করেন দেলওয়ার হোসেন । তিনি জানান, ইউটিউবের জন্য প্রথমে গ্রামের ৭ বেকার যুবক বাঁশের বিভিন্ন ব্যবহার নিয়ে ভিডিও আপলোড করার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান হয় ।
আমাদের রান্নার কাজ দেখতে অনেক দূর থেকে লোকজন আসতো। তখন বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য এসব তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে করে একদিকে যেমন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হয়েছে, তেমনি দর্শনার্থীদের বিনোদনের ব্যবস্থা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভিডিওর মাধ্যমে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহার সম্পর্কে সবাই জানতে পারছে। সব চাইতে বড় কথা আমাদের মাধ্যমে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এর চাইতে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।
‘ইউটিউবের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবন তুলে ধরা হচ্ছে বিশ্বের মানুষের সামনে। আমাদের গর্বের বিষয় এটি। এটির মাধ্যমে আমাদের গ্রাম ও গ্রামের মানুষের উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে।’
তিনি বলেন, ইউটিউব থেকে এখন ভালোই উপার্জন হয়। সেখান থেকে প্রতি মাসে ৫০ জনকে সম্মানী দেওয়া হয়। এখন আমি গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি। পাশাপাশি অসহায় মানুষের মুখে সামান্য খাবার তুলে দিতে পারছি, বেকারকে চাকরি দিতে পারছি। এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।
প্রতিনিধি/এএ