জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে রাজশাহীতে হত্যাচেষ্টা মামলার এজহারভুক্ত এক আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। তাকে সাথে নিয়েই গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন করা হয়েছে! এছাড়া হাসিনার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা বেতন তুলেছেন ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলার অন্যতম ওই আসামি। তাকে বাঁচাতে দফায় দফায় করা হয়েছে ‘গোপন বৈঠক’। ঢাকা মেইলের বিশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
হত্যাচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির নাম মো. মকছেদুর রহমান। তিনি জেলার পবা উপজেলার কাটাখালি পৌরসভার হাজরাপুকুর এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা মৃত মনির হোসেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। মকছেদুর জেলার পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং অ্যান্ড ওয়ার্কশপ প্র্যাকটিস বিষয়ের ইন্সট্রাক্টর (শিক্ষক)। তার ইনডেক্স নম্বর আর৩০০১০৫৫ এবং টিন নম্বর ৩১৪৯৬২৩৬১৬৭৭।
বিজ্ঞাপন
২০০৩ সালের ১৩ মে তিনি বিড়ালদহ কলেজে যোগদান করেন। এরপর ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে তার মান্থলি পে অর্ডার (এমপিও) হয়। বর্তমানে মাসে তার বেসিক বেতন ৩২ হাজার ৩৯০ টাকা। মকছেদুর রহমান গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) বোয়ালিয়া মডেল থানায় দায়ের হওয়া মামলার এজহারভুক্ত ৭ নম্বর আসামি।
পবা উপজেলার কাটাখালির শ্যামপুর এলাকার আতাউর রহমানের ছেলে মো. রোকনুজ্জামান বাদী হয়ে ৯৩ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাত আরও ৩০০ জনের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। স্বৈরাচার হাসিনার পতনের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন রোকনুজ্জামান। তার চাচা প্রয়াত অধ্যাপক মাজিদুর রহমান জামায়াতে ইসলামীর রাজশাহী মহানগরীর ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক ও কাটাখালি পৌরসভার মেয়র ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৬ আগস্ট থেকে পুঠিয়ার বিড়ালদহ কলেজে অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন থেকে কলেজের খাতায় তার স্বাক্ষর রয়েছে মকছেদুর রহমানের। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিনি কলেজে আসতে থাকেন। তার ব্যাপারে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কলেজের অধ্যক্ষ ও সভাপতি ছিলেন নীরব ভূমিকায়।
সূত্র জানায়, হাসিনার পতনের পরও বিড়ালদহ কলেজে আওয়ামী লীগ মনোনীত ডা. আলম নামে এক ব্যক্তি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। পরে বিএনপি নেতাদের আপত্তির মুখে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পুঠিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক আলতাব হোসেনকে নতুন সভাপতি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলার এজহারভুক্ত আসামি হয়েও মকছেদুর রহমান বিড়ালদহ কলেজে অফিস করেছেন। অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলামের কক্ষে উত্তর-পশ্চিম কর্নারে ডায়াসে হাজিরার খাতা রাখা থাকে। সেখানে গিয়ে তিনি নিয়মিত স্বাক্ষরও করেছেন হাজিরা খাতায়। সবশেষ গত মঙ্গলবারও (২২ এপ্রিল) তিনি কলেজে যান এবং স্বাক্ষর করেন। তার স্বাক্ষরিত হাজিরার সম্পূর্ণ কপি ঢাকা মেইলের হাতে এসেছে। এছাড়া প্রতি মাসে বেতনও তোলেন তিনি। মকছেদুর রহমান সোনালী ব্যাংকের পুঠিয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাঞ্চ থেকে গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আট মাসে দুই লাখ ৬৫ হাজার ১৬৮ টাকা বেতন পেয়েছেন। সর্বশেষ মার্চ মাসের ২৫% ঈদুল ফিতরের বোনাসসহ ৪০ হাজার উত্তোলন করেছেন তিনি। শেষবার সোনালী ব্যাংক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাঞ্চ থেকে বেতন তোলেন মকছেদুর। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ৪৬১৬০০২০৮৮২০৫ এবং রাউটিং নম্বর ২০০৮১১৮৪৪।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে গত ১৪ এপ্রিল বিড়ালদহ কলেজে ইলিশ-পান্তা উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম, সভাপতি প্রফেসর আলতাব হোসেনসহ অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীরা ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে মকছেদুর রহমানও হাজির হন এবং সকলের সাথে ইলিশ ও পান্তা ভাত খান। এ সময় পুঠিয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আলামিন সরকার ও আহসান নামে আরেক যুবদল নেতাকে কলেজ কমিটির সভাপতি আলতাব হোসেন ডাকেন। ওইদিন পহেলা বৈশাখ উৎসবে মকছেদুরের বিষয়টি আলোচনায় উঠে।
অনুসন্ধান বলছে, তার ব্যাপারে প্রশ্ন উঠলেও তখনও পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কিছুই জানানো হয়নি। তাকে নিয়েই গান-বাজনা করে ইলিশ-পান্তা উৎসব শেষ হয়। এমনকি কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম সভাপতির ওপর দায়িত্ব দিয়ে কলেজ থেকে ১৪ এপ্রিল বিকেলেই শহরে চলে আসেন। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি আর কলেজেই যাননি।
এদিকে, ১৫ এপ্রিল সকালে কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে আসামি মকছেদুরকে নিয়ে ‘গোপন বৈঠকে’ বসেন কমিটির সভাপতি আলতাব হোসেন। সেখানে ইসমাইল নামে ওই কলেজের আরেক শিক্ষক ছিলেন। একজন পিওনকে নাস্তা আনতে পাঠানো হয়। আর বাকিদের ওই কক্ষে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। দরজা ও জানালা বন্ধ করে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক।
অভিযোগ উঠেছে, এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে মকছেদুর রহমানকে বাঁচিয়ে দিতে চেয়েছেন কলেজ কমিটির সভাপতি আলতাব হোসেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুবদল নেতা আলামিন ও আহসান কাজ করেছেন। তারাও ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে কলেজে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কলেজ অধ্যক্ষের কাছে সভাপতি আলতাব বিভিন্ন কথা বলে ইতোমধ্যে ৫৭ হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানিয়েছে, মকছেদুর চাঁদা দিতে না চাওয়ায় বিষয়টি জেলা বিএনপি পর্যন্ত গড়ায়। গত সোমবার (২১ এপ্রিল) সকাল ৮টায় জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সাঈদ চাঁদের বাসায় যান কলেজ অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম, সভাপতি আলতাব হোসেন ও অন্যান্য শিক্ষকরা। সেখানে মকছেদুর রহমানও ছিলেন। ঘটনা জানার পর মকছেদুরকে কলেজে যেতে নিষেধ করেন চাঁদ। তার পরদিন মঙ্গলবারও (২২ এপ্রিল) মকছেদুর কলেজে যান এবং খাতায় স্বাক্ষর করেন।
এ ব্যাপারে কমিটির সভাপতি আলতাব হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রিন্সিপ্যাল রফিকুলই মকছেদুরকে চাঁদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেছেন।’ তবে অধ্যক্ষের দাবি, আলতাবই মকছেদুরকে চাঁদের কাছে নিয়ে যান।
সূত্র জানায়, অধ্যক্ষ রফিকুল ও সভাপতি আলতাব সম্পর্কে চাচা শ্বশুর ও জামাই। ছাত্রজীবনে তারা দুজন এক হলে এক রুমে ছিলেন। ২০০২ সালের ১১ আগস্ট বিড়ালদহ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান রফিকুল। আর এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি সভাপতি হয়েছেন আলতাব। বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে কলেজটিতে সরেজমিনে গিয়ে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অধ্যক্ষ রফিকুল ও সভাপতি আলতাব একে অপরকে দুষতে থাকেন। এ সময় দায়সারা কথা বলেন তারা।
এ ব্যাপারে বিড়ালদহ কলেজ কমিটির সভাপতি প্রফেসর আলতাব হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মকছেদুর আসামি হয়ে কলেজে আসছে, বেতন উঠাচ্ছে; আমি বিব্রত। আমি আগে জানতাম না। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠানে ছিলাম কলেজে, ওইদিন আমি অবগত হয়েছি। কিন্তু অধ্যক্ষ জানার পর ছুটি নিয়ে আমার ওপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়। তবে উনি (মকছেদুর) যে চাঁদ ভাইয়ের ওখান থেকে আটক হননি, এটাই আমি অবাক হচ্ছি! সে (মকছেদুর) নির্যাতিত হতে পারে; সুপারমর্শ চায় সে, আমি তাকে জামিন নিতে বলি।’
এ বিষয়ে বিড়ালদহ কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি আগে তার বিষয়টি জানতাম না, পহেলা বৈশাখ থেকে জানি। সভাপতি স্যার সেদিন ছিলেন। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ, তার পরদিন ১৫ তারিখ থেকে শহরে আমার ট্রেনিং ছিল ৬ দিনের। ২০ তারিখে আমি কলেজে আসি ট্রেনিং শেষ করে। আমি তাকে বলেছি, তুমি আর কলেজে আসিও না।’
হত্যাচেষ্টা মামলার এজহারভুক্ত আসামিকে নিয়ে ইলিশ-পান্তা খাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পান্তা খাওয়ার পরে আমি জেনেছি।’ এরপরেও মকছেদুর কলেজে গিয়ে স্বাক্ষর ও অফিস করেছেন এমন প্রশ্নে রফিকুল বলেন, ‘অনেক সময় অফিসে যেতে আমার দেরি হয়, তাই সে আগেই কলেজে গিয়ে স্বাক্ষর করে ফেলে।’
অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি শহরে ট্রেনিংয়ে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে সভাপতি আসামির সাথে আমার অফিসে ২-৩ দিন গোপন বৈঠক করেছেন। তিনি মকছেদুরের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেছেন।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সভাপতি আলতাব হোসেন বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আই ক্যান চ্যালেঞ্জ ইউ।’ মকছেদুরের বেতন উত্তোলন প্রসঙ্গে কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, ‘ইএফটির মাধ্যমে বেতন আসে। তাই আমাদের কারও স্বাক্ষর লাগে না।’
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী জোনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. ওলিউজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ না হওয়া পর্যন্ত টাকা উত্তোলন বা লেনদেনে কোনো বিধিনিষেধ নেই।’
আর চাঁদা চাওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে পুঠিয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আলামিন সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি নিজেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। আমি চাঁদা চাইলে আগেই চাইতে পারতাম। ৯ মাস পর কেউ চাঁদা চাইবে? এটা শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি হবে। অভিযোগটি সঠিক নয়।’
এসব ব্যাপারে অভিযুক্ত মকছেদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘আমার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার ভাই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। ২০০২ সাল থেকে আমি কোনো দল করি না। ৫ আগস্ট আমি বাইরেই বের হইনি, বাসায় টিভি দেখছিলাম। আমি বিপদে পড়ে গেছি।’
মামলার বাদী মো. রোকনুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসামিদের সেভাবে ধরা হচ্ছে না। মাত্র কয়েকজন আটক হয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম, পরে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার চাই।’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি, মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অনেককেই পুলিশ গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনেছে। ছাত্র আন্দোলনে হামলায় জড়িত ও অভিযুক্ত কেউ ছাড় পাবে না। অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
প্রতিনিধি/জেবি

