শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫, ঢাকা

রাজশাহীতে পুলিশের ‘সহযোগিতায়’ প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ!

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:১২ পিএম

শেয়ার করুন:

রাজশাহীতে পুলিশের ‘সহযোগিতায়’ প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ!
রাজশাহীতেও আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীতে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ‘বুক ফুলিয়ে’ প্রকাশ্যে ঘুরছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এজহারভুক্ত মামলার আসামি হলেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। শোডাউনও দিচ্ছেন এলাকায়। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদও পরিচালনা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এতে সিনিয়র রাজনীতিবিদরা চরম ক্ষুব্ধ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটনের পুলিশের (আরএমপি) ১২ থানায় মোট মামলা হয়েছে ৪২টি। এসব মামলায় মোট আসামি ৯ হাজার ৭৭৫ জন। এদের মধ্যে এজহারভুক্ত আসামি ২ হাজার ৫ জন। আর ৭ হাজার ৭৭০ জন রয়েছেন অজ্ঞাতনামা আসামি। এ পর্যন্ত মাত্র ২০০ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


আরএমপির মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার ওপর হামলা ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের প্রতিদিনই গ্রেফতার করা হচ্ছে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জেলা পুলিশের থানায় দায়ের হয়েছে ৩৫টি মামলা। এসব মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৬১৮ জন। তবে মামলার আসামি সংখ্যা জানায়নি জেলা পুলিশ। অভিযোগ উঠেছে, এজহারভুক্ত আসামিরা প্রক্যাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ তাদের ধরছে না। আসামিরা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন পুলিশের কর্মকর্তাদের। আসামির তথ্য দেওয়া হলে অভিযানে নামার আগেই আসামিকে টেলিফোন করে সরে যেতে বলছে পুলিশ।

আরও পড়ুন

হাসিনার ‘ভার্চুয়াল বৈঠক’ ঘিরে আ.লীগে কী চলছে?

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রতিমন্ত্রী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদুদ দারাসহ ৬০ জনের নামে চাঁদাবাজি ও বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা হয়। জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সুখানদিঘি এলাকার রাকিবুল ইসলাম মামলাটি করেন। মামলার এজহারভুক্ত আসামি ২০ জন। ওই মামলার ৪ নম্বর আসামি বেলপুকুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বদি। তিনি বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন। বদির ছেলে সুমনুজ্জামান সুমন পুঠিয়া উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনিও মামলার আসামি।

Police2_2
জুলাই আন্দোলন দমাতে পুলিশ ছিল মারমুখী। ছবি: সংগৃহীত

সূত্র জানিয়েছে, বদি এখনো এলাকায় ‘বুক ফুলিয়ে’ চলছেন। বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদও চালাচ্ছেন তিনি। সরকারি বরাদ্দের ত্রাণ তিনি তালিকা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিচ্ছেন। সর্বশেষ বুধবারও (৮ জানুয়ারি) তিনি ইউনিয়ন পরিষদে ছিলেন। তার ছেলে সুমনও রয়েছেন এলাকায়। তবে রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের ধরছে না। অথচ বদির নিজের গ্রাম পুঠিয়ার জামিরায় অভিযান চালিয়ে রাজু আহমেদ পনি নামে আওয়ামী লীগের এক সমর্থককে গ্রেফতার করে আরএমপির বোয়ালিয়া থানা পুলিশ।

সূত্র জানায়, জেলার দুর্গাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাগমারা উপজেলার গণিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমজাদ হোসেন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার ছেলে হিটলার মাহমুদ যুবলীগের নেতা। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির ডান হাত ছিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ছাড়াও হিটলারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্রীর বাসা জেলার বাগমারায়।

আরও পড়ুন

পাঠ্যবইয়ে আওয়ামী লীগকে ‘সবচেয়ে বড়’ দলের তকমা

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ২০২০ সাল থেকে যুবলীগের কর্মী হিটলার আমাকে ধর্ষণ করেছে। তার বাবা আমজাদ হোসেন মেম্বার গণিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আওয়ামী লীগ আমলে সরকার দলীয় দাপট দেখাতো। কিন্তু তার মামা সাখাওয়াত হোসেন বল্টু বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও মনোনয়ন প্রত্যাশী, তার খালু বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা এনামুল হক বাসুপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি। এখন সে তাদের পরিচয়ে বিএনপির দাপট দেখাচ্ছে।

ওই কলেজছাত্রী আরও বলেন, পুলিশ তাদের ধরছে না। আমি থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। আওয়ামী লীগের ওই নেতারা বিএনপির আশ্রয়ে আছে। পুলিশকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছে। তাই তাদের গ্রেফতার করছে না। ধর্ষণের বিচার পাওয়া নিয়ে আমি শঙ্কায় আছি।

এ ব্যাপারে বাগমারা থানার ওসি তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, কলেজছাত্রী মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে। আমরা তার কথা শুনে লিখিত অভিযোগ নিয়েছি। তবে সে নিজেই আমাদের অফিসারের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে।

সূত্র আরও জানায়, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সোহরাব আলী খান প্রকাশ্যে নেতাকর্মী নিয়ে শোডাউন দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। সোহরাব মোহনপুরের ধুরইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর ওই স্কুলের ছাত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর ও অশ্লীল কথাবার্তা বলার দায়ে স্থানীয়রা তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। সেই সোহরাব সম্প্রতি জেলার মোহনপুরে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যও দিয়েছেন। বাঘা ও চারঘাটে আওয়ামী লীগের ফখরুল, একরামুল, আক্কাস, লাবু ও মুক্তারসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলে ভিড়ছেন। মহানগর শ্রমিক লীগের শীর্ষ এক নেতা ইতোমধ্যে বড় একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সভাপতি বনে গেছেন! ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন মামলার এজহারভুক্ত অনেক আসামি। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম এবং রাজশাহী সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার খায়রুজ্জামান লিটন সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেক আগেই। জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকারের শুধু রাজশাহী-৩ (পবা- মোহনপুর) ও রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গত বছরের অক্টোবর মাসে এ দুজনকেই র‌্যাব গ্রেফতার করে। এসব ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পুলিশ তো কোনো কাজই করছে না। পুলিশ আওয়ামী লীগের সাথে লিয়াজোঁ করে চলছে এবং রাতের অন্ধকারে টাকা, অবৈধ ফেনসিডিলের ব্যবসা এগুলোর সাথে পুলিশ জড়িত, মাদকের সাথে পুলিশ জড়িত। ঠিক আগে যে অবস্থা ছিল এখনো তাই। চারঘাট-বাঘাতে মাদকের লোকজন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং পুলিশের সাথে তাদের যোগাযোগ। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে পুলিশের সহযোগিতায়।’

Julay2
আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপির প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘আমাদের নেতা তারেক রহমান সাহেব তো এগুলো দেখতে মানা করেছে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে যেতে মানা করেছে, যার জন্য আমরা কথা বলছি না। কিন্তু আসলে তো ঘটনা- পুলিশ নিষ্ক্রিয়। একটা অস্ত্র কিন্তু এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। আওয়ামী লীগের এত অস্ত্র আছে, চারঘাট-বাঘায় শাহরিয়ার (সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) যত অস্ত্র দিয়েছিল, একটা অস্ত্র তারা উদ্ধার করতে পারেনি। কীসের জন্য করছে না বা কী ব্যাপার?’

আবু সাঈদ চাঁদ অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশের কিন্তু কোনো কাজ বা দক্ষতা এই ৫ মাসে আমরা দেখতে পাইনি, লক্ষ্য করিনি। একদম নিষ্ক্রিয়। পুলিশ কোনো কাজ করছে না। পুলিশ সচল হোক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের দায়িত্ব পালন করুক, সেটা তো করছে না। বরং আগেও মাদকের সাথে পুলিশ জড়িত ছিল, এখনো মাদকের সাথেই জড়িত। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে পুলিশের সহযোগিতায়। আমরা (পুলিশকে) বলছি, আসেন। আসতে লাগবে ৪ ঘণ্টা, ওখান থেকে আগে টেলিফোন করে দিচ্ছে, আপনারা হেটি (সরে) যান, তারপর (আসামিরা) হেটি (সরে) যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন

রাজনীতি নিষিদ্ধ, তবু বেরোবিতে আ.লীগপন্থী শিক্ষকদের নির্বাচনের তোড়জোড়!

রাজশাহী মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম রবি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রথমত পুলিশের অবহেলা আছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে যেতে তারা ভয় পাচ্ছে কি না আল্লাহ ভালো জানেন। দ্বিতীয় বিষয় হলো, অনেকে টাকা-পয়সা দিয়ে কনভেন্স করছে, ওদেরকে ধরছে না। যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলার জড়িত না, নিরীহ মানুষ, তাদেরকে যাতে মামলায় না ফাঁসাতে পারে। যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাই।’

এসব ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মামলায় যারা অভিযুক্ত আরও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। আমি প্রশাসনসহ সবাইকে বলেছি যে, আপনারা দ্রুত ব্যবস্থা নেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক। দলীয় যারা সহিংসতায় ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’

এসব বিষয়ে জানতে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার ফারজানা ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে সংস্থাটির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর