জাজিরা থানার তথ্যমতে কুদ্দুস ব্যাপারী (বোমা কুদ্দুস) ও জলিল মাদবরের বিরুদ্ধে একাধিক থানায় দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৯৭টি। যার অধিকাংশই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের। বালতিতে ককটেল ভরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় ‘খইয়ের মতো’ বোমা ফুটিয়ে দেশজুড়ে এখন আলোচনায় তারা। এখানে পান থেকে চুন খসলেই বেড়িয়ে আসে শত-শত হাতবোমা। এত বিস্ফোরক দ্রব্য কোথায় পেল তারা তা জানতে অনুসন্ধানে ঢাকা মেইল।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে দেখা মেলে হাতবোমা তৈরির এক কারিগরের সঙ্গে। তার থেকে জানা যায় অনেক কিছুই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, টাকার বিনিময়ে তিনি কুদ্দুস ব্যাপারীর লোকজনকে ককটেল তৈরি করে দেন। ওই পক্ষের লোকজন গোলাবারুদ (বিস্ফোরক) এনে দেন। সেটা দিয়ে তিনি ককটেল তৈরি করেন। একেকটি অর্ডারে কমপক্ষে ৫০টি করে ককটেল তৈরি করা হয়। এর জন্য পারিশ্রমিক পান ২০ হাজার টাকা। গ্রামের নির্জন স্থানে, বাগানে, পদ্মা নদীর চরে বা নৌকায় বসে এ কাজ করেন।
বিজ্ঞাপন
গত ১৫ বছরে বিলাসপুরে ককটেল বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের ভাষ্য, কুদ্দুসের ভাই সিদাম ব্যাপারী ও জলিলের ভাই বিদ্যুৎ মাতবরের নেতৃত্বে অন্তত ১০টি দল ককটেল বোমা তৈরির কাজ করে। ইউনিয়নের মুলাই ব্যাপারীকান্দি, মেহের আলী মাতবরকান্দি, ইয়াছিন মাতবরকান্দি, মিয়াচান মুন্সিকান্দি, কাজিয়ারচর, পাচু খাঁরকান্দি এলাকা ও পদ্মা নদীর বিভিন্ন চরে বসে ওই দলগুলো ককটেল বোমা তৈরি করে।
এ ঘটনা চলছে গত ২৫ বছর ধরে। যাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। আহত হয়েছেন কয়েক শ বাসিন্দা। তবে বিরোধ আরও পুরোনো। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অন্তত ৪০ বছর ধরে এখানকার দুই পক্ষের মধ্যে সহিংসতা চলছে। বিলাশপুর ইউনিয়নের ২১ গ্রামেই ছড়িয়ে পড়েছে এই বিরোধ।
বর্তমানে এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কুদ্দুস ব্যাপারী (বোমা কুদ্দুস), আরেক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জলিল মাদবর। তাদের বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় ককটেল বোমা তৈরি করেন, এমন অভিযোগ আছে।
জাজিরা থানা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, জাজিরা উপজেলার ওপর দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা বিলাশপুর ইউনিয়নটি ভাঙনপ্রবণ। ওই এলাকার জেগে ওঠা চরের জমির দখল নেওয়া, পদ্মা নদীর নৌপথ নিয়ন্ত্রণ, বালু তোলা নিয়ন্ত্রণ, মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণ, ইউপি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সহিংস বিরোধ চলে।
ককটেল বানাতে গিয়ে হাত ও পা হারিয়েছেন, এমন দু'জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তারা সবাই সাম্প্রতিক সংঘাতের ঘটনায় পুলিশের করা বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় আসামি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, কুদ্দুসের লোকজন একসময় তাদের ওপর অত্যাচার করতেন। তাদের মোকাবিলা করার জন্য ও এলাকায় টিকে থাকার জন্য তারা ককটেল তৈরির উদ্যোগ নেন। ২০১২ সালে ২০ এপ্রিল ককটেল বিস্ফোরণে তার হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পায়ের মাংসে ক্ষত সৃষ্টি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আহত ব্যক্তি বলেন, জেলার সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন দলের মানুষ জানে, বিলাসপুরে কারা ককটেল বানান। তারা ওই লোকজনের মাধ্যমে বিলাসপুর থেকে ককটেল সংগ্রহ করেন। নানা সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এগুলো ব্যবহার করা হয়।
গত শনিবার (৫ এপ্রিল) ককটেল বিস্ফোরণের সর্বশেষ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুই পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ককটেল তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়া সিদাম ব্যাপারী ও বিদ্যুৎ মাতবর ওই মামলায় আসামি হয়ে পলাতক। আর কুদ্দুস ও জলিল কারাগারে। এ কারণে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের কাছে দুই ধরনের তথ্য আছে। এক হচ্ছে, বিলাসপুরে কিছু ‘এক্সপার্ট’ আছেন, যারা ককটেল বানান। তারা বিবাদমান দুই পক্ষের লোকজন। আবার সহিংসতা ঘটানোর জন্য বাইরে থেকেও লোক আনা হয়। বিস্ফোরণ ঘটানো ককটেল কোথায় বানানো হচ্ছে, কারা বানাচ্ছেন, এর কাঁচামাল কোথা থেকে কীভাবে আসছে, তা খোঁজার জন্য কাজ করছে পুলিশ। বিলাসপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাটি পুলিশকে বিব্রত করেছে। ওই ঘটনায় করা মামলায় দুই পক্ষের নেতা ও তাদের সমর্থকদের আসামি করা হয়েছে। প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছে। তার কাছ থেকে তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।
প্রতিনিধি/এসএস