শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

মেঘনার ভাঙনে গজারিয়ার মানুষ দিশেহারা

জেলা প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ 
প্রকাশিত: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদী তীরবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামে দেখা দিয়েছে ভাঙ্গন। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বসতবাড়ি, গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর এলাকায়।  বসতভিটা রক্ষায় ভাঙ্গন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

বুধবার (৩ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার নয়ানগর এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, মেঘনা নদীর পাড়ের নয়ানগর শাহী জামে মসজিদের নিচ থেকে মাটি সরে কলাম বেরিয়ে এসেছে। মাটি সরে যাওয়ায় মসজিদ রক্ষা বাঁধের ব্লক সহ দেয়াল ধসে পড়েছে।


বিজ্ঞাপন


munsi_1

স্থানীয়রা জানায়, বর্ষার পানির বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভাঙ্গনের তীব্রতা। কয়েকটি বসত-বাড়ির সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে পড়ে যাচ্ছে নদীতে অন্যদিকে বেশ কয়েকটি বাড়ি-ঘরের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় হেলে আছে এক পাশে।

এ সময় ভাঙন কবলিত স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ৮-১০ বছর আগেও নয়ানগর মসজিদ থেকে ৪০০ মিটার পশ্চিমে ছিল মেঘনা নদী। নদী ও মসজিদের মধ্যখানে মানুষের ঘর-বাড়ি,ফসলি জমি ছিল। গত কয়েক বছর ধরে মেঘনা নদীর নিরব ভাঙন চলছে। ভাঙনে মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বসত-ভিটা,জমিজমা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

munsi_2


বিজ্ঞাপন


গত বর্ষায় ভাঙতে ভাঙতে সেটি মসজিদের কাছাকাছি এসে ঠেকেছিল। কয়েকদিন আগে ঘুর্ণিঝর রিমালের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধিপায়।

সে সময় নদীর ঢেউ ও স্রোতের কারনে আকষ্মিক ভাঙন শুরু হয় নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। এতে নদীর পাড়ের বাসিন্দা, তারা মিয়া, জাহাঙ্গীর মাস্টার, রফিকুল ইসলামদের বসত ভিটা বিলীন হয়ে যায়। 

munsi_3

বাড়ির তলদেশের মাটি সরে পেয়ারা বেগম, আওয়াল গাজী,আজি লারীদের ঘর ভেঙ্গে পড়েছে নদীতে। ভেঙে গেছে বসত বাড়ির সুরাক্ষা দেয়াল। ভাঙন ঝুঁকিতে পড়েছে এই এলাকার তিনশ বছর পুরোনো নয়ানগর শাহী জামে মসজিটিও।

স্থানীয়রা বলেন, দু'দিন নদীতে বেশি পানি ছিল, তাতেই এতো ক্ষতি। যদি ভাঙন চলতে থাকে। এবার বর্ষার আগে ভাঙন ঠেকাতে কোন পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে পানি বাড়ার সাথে নয়ানগর গ্রামের মসজিদ সহ সাড়ে চারশতাধিক বসত-ভিটা নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে।

munsi_4

ভাঙনের শিকার হত দরিদ্র তারা মিয়া প্রধান (৭৫)। তিনি নয়ানগরের প্রয়াত আয়াত আলী প্রধানের ছেলে। বংশ পরম্পরায় এ এলাকায় বসবাস তার। তারা মিয়ার স্ত্রী, শারীরিক প্রতিবন্দ্বি একছেলে ও বিধবা এক মেয়ে, মেয়ের ঘরে এক নাতিকে নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছোট ভাঙা ঘরে থাকতেন তাঁরা। মানুষের সাহায্যে সহযোগিতায় কোন রকমে চলে তাদের সংসার। গত ২৮ মে ঘূর্ণিঝর রিমালের সময় নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। সে সময় স্রোত ও ঢেউয়ের কারনে একটি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

munsi_5

তারা মিয়া প্রধান বলেন, বাপ-দাদার জমি-জমা চোখের সামনে ভাঙতে ভাঙতে শেষ হইলো। শেষ সম্বল ভিটা-মাটিডা আছিল। এইডাও ভাইঙ্গা যাইতাছে। একটা ঘর শেষ।সরকার ব্যবস্থা না নিলে অন্যডাও ভাইঙ্গা যাইবো। ঠিকমত খাওন জোডেনা। নতুন কইরা ঘর করা, জায়গা কিনা,কোনডারই সামর্থ নাই।

অন্যদিকে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ জাহাঙ্গীর মাস্টার বলেন, প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো আমাদের গ্রামটি। একটু একটু করে মেঘনা ঘিলে খাচ্ছে। একের পর এক আমরা ঘরবাড়ি হারা হচ্ছি। কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এর আগেও মেঘনার ভাঙনে ভিটে-মাটি হারান মো. আলী কাজী, মো. আরাফাতরা।

munsi_6

এদিন কথা হয় এ দু’জনের সঙ্গে। তারা জানান, আমাদের সামর্থ ছিল আমরা অন্যত্রে বাড়ি করে আছি। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরীব। দিন আনে দিন খায়। একবার কেউ ভাঙনের শিকার হলে মাথা গোজার ঠাই টুকুও হারাবে। তাই বাসিন্দাদের বসত-ভিটা, ঐতিয্যবাহী মসজিদ, একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রামটি রক্ষা করতে হলে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন আটকাতে হবে। মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ীভাবে বেরি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। 

munsi_7

ইউনিয়নটির এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মামুন জানালেন একই কথা। তিনি বলেন,এলাকার ক্ষয়ক্ষতির ছবি তুলে ইউনিয়ন কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।এ গ্রামটি বাঁচাতে হলে বেরিবাঁধের বিকল্প নেই।

ওই এলাকাটি পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা করা হয়েছে বলে জানান গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)কোহিনুর আক্তার। 

munsi_8

তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ৬ জন ক্ষতিগ্রস্তের নাম পেয়েছি। তাঁদের ঢেউ টিন ও খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। ওই এলাকার ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। এই এলাকার ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

তবে তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙন ঠেকাতে সেখানে জিওব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুন্সিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম।

munsi_9

তিনি বলেন, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের কাজ শুরু করেছে। কমিটির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে। বরাদ্দ পেলে সেখানে কাজ শুরু করা হবে।

প্রতিনিধি/ এজে

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন