ধর্ম ডেস্ক
২১ নভেম্বর ২০২২, ০৪:৩৯ পিএম
মানবজীবনের সব দিক ও বিভাগে যাঁকে অনুসরণ করলে মহান আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জিত হবে, তিনি হলেন সেই সর্বোত্তম আদর্শ বিশ্বনবী (স.)। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে রাসুল, আপনি বলে দিন- তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ করো; তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন (সুরা ইমরান :৩১)
প্রিয়নবী (স.)-কে কীভাবে অনুসরণ করতে হবে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাহাবায়ে কেরাম। তাঁরা উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মানুষ। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন সাহাবিরা। নবীজির নির্দেশনার সামনে তাদের কোনো বক্তব্য থাকত না। যেকোনো সাহাবির জীবনধারা পর্যালোচনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে হাদিসের আলোকে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবির নবীজিকে অনুসরণের বিভিন্ন ঘটনা ও আমল তুলে ধরা হলো। যেখানে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর জন্য নবীজিকে অনুসরণের বাস্তব শিক্ষা।
১) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাপ-দাদার নামে কসম করতে নিষেধ করেছেন। ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে এ কথা বলতে শুনেছি, তখন থেকে আমি তাদের নামে কসম করিনি; মনে থাকা অবস্থাতেও না, অন্যের কথা উদ্ধৃত করেও না।’ (সহিহ বুখারি: ৬৭৪৪)
আরও পড়ুন: ওমর (রা.) যেসব কারণে ইতিহাসে অনন্য
২) আবু বকর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) যা করতেন আমি তা পরিহার করব না, বরং আমি তা করব। আমি ভয় পাই যদি আমি তাঁর সামান্য কোনো বিষয় পরিহার করি, তবে পথভ্রষ্ট হবো।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৯৭০)
৩) সাঈদ (রহ.) বলেন, ‘ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, রক্তপণে বংশের লোকদের অংশ আছে। স্ত্রী তার স্বামীর দিয়াতের ওয়ারিস হয় না। দাহহাক ইবনু সুফিয়ান (রা.) তাঁকে বললেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে লিখিত নির্দেশ পাঠান: আশআম আদ-দিবাবির স্ত্রীকে তার রক্তপণের ওয়ারিশ বানাও। তখন ওমর (রা.) নিজের মত পরিবর্তন করেন।’ (সুনানে আবু দাউদ: ২৯২৭)
৪) মুজাহিদ (রহ.) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর এক সফরে সঙ্গে ছিলাম। তিনি একটি স্থান অতিক্রম করার সময় সেখানে পার্শ্বপরিবর্তন করলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি এমন করলেন কেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে এমনটি করতে দেখেছি।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪৮৭০)
৫) আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হাজরে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিতভাবে জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কারও কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। নবী (স.)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। এরপর তিনি চুম্বন করলেন। পরে বললেন, আমাদের রামল করার উদ্দেশ্য কী ছিল? আমরা তো রামল করে মুশরিকদের আমাদের শক্তি প্রদর্শন করেছিলাম। আল্লাহ এখন তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। এরপর বললেন, যেহেতু এই (রামল) কাজটি আল্লাহর রাসুল (স.) করেছেন, তাই তা পরিত্যাগ করা পছন্দ করি না।’ (সহিহ বুখারি: ১৬০৫)
আরও পড়ুন: সাহাবিদের ওপর কঠিন নির্যাতনের চিত্র
৬) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এক ব্যক্তির হাতে একটি স্বর্ণের আংটি দেখে সেটি খুলে ফেলে দিলেন এবং বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আগুনের টুকরা সংগ্রহ করে তার হাতে রাখে। রাসুলুল্লাহ (স.) প্রস্থান করলে লোকটিকে বলা হলো, তোমার আংটি তুলে নাও, এর দ্বারা উপকার লাভ করো। সে বলল, না। আল্লাহর শপথ! আমি কখনো ওটা নেব না। রাসুলুল্লাহ (স.) তো ওটা ফেলে দিয়েছেন।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৩৬৫)
৭) উম্মুল মুমিনিন হজরত উম্মে হাবিবা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১২ রাকাত সুন্নত নামাজ পড়বে, এর প্রতিদান হিসেবে জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর বানানো হবে’ তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে হাদিসটি শোনার পর থেকে এ নামাজগুলো কখনও ছাড়িনি। (সহিহ মুসলিম: ৭২৮)
৮) আয়েশা (রা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা প্রাথমিক যুগের মুহাজির নারীদের ওপর অনুগ্রহ করুন, যখন আল্লাহ এই আয়াত ‘তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন ওড়না দ্বারা আবৃত করে’ অবতীর্ণ করলেন, তখন তারা (বিলম্ব না করেই গায়ে থাকা) নিজ চাদর ছিঁড়ে তা দিয়ে মুখমণ্ডল ঢাকল।’ (সহিহ বুখারি: ৪৭৫৮)
আরও পড়ুন: ইতিহাসের পাতায় সুউজ্জ্বল পাঁচ কিশোর সাহাবি
৯) হজরত আলী (রা.) বলেন, ফাতেমা (রা.) একবার একজন খাদেম চাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে যায়। তখন রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে বললেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়েও উত্তম এক জিনিসের কথা বলে দেবো? (এ কথা বলে তিনি বলেন) তুমি ঘুমানোর সময় ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর বলবে। (অর্থাৎ এটি তোমার জন্য খাদেমের চেয়েও উত্তম হবে) (সহিহ বুখারি: ৫৩৬২)। সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের দুজনকে লক্ষ্য করে এ আমলটির কথা বলেছেন। আলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে শোনার পর থেকে আমলটি আমার কখনও ছুটেনি। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, সিফফিনের রাতেও কি ছুটেনি? উত্তর দিলেন, না, সিফফিনের রাতেও ছুটেনি। (সহিহ মুসলিম: ২৭২৭)
১০) হজরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ) তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন ওমর থেকে বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, আব্দুল্লাহ বেশ ভালো ছেলে, যদি সে রাতের নামাজ পড়ত! হজরত সালেম (রহ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর এ কথা বলার পর থেকে আমার আব্বা আব্দুল্লাহ রাতে খুব কমই ঘুমাতেন। (সহিহ বুখারি: ৩৭৩৯; সহিহ মুসলিম: ২৪৭৯)। কথাটি রাসুলুল্লাহ (স.) যখন বলেছিলেন, তখন আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) ছিলেন যুবক। আর তাঁর ছেলে সালেম (রহ) যখন এ কথাটি বলছেন, তখন ছেলেও হয়ে গেছেন যুবক। সময়টা খেয়াল করুন কত দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে কখনও আমলটি ছুটেনি।
আরও পড়ুন: মহানবী (স.)-এর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া মুক্তি নেই
সুবহানাল্লাহ! নবীজির নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমল শুরু করতেন সাহাবিরা। তা-ও সারাজীবনের জন্য। আমলে কতইনা অবিচল ছিলেন তাঁরা! তাঁদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রয়েছে উত্তম প্রতিদান। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি এবং যেসব মুসলমান আপনার সঙ্গে রয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট।’ (সুরা আনফাল: ৬৪)।
আরব জাতি ছিল নানা গোত্রে বিভক্ত, কলহপ্রিয়, অধঃপতিত, যাযাবর ও বর্বর একটি জাতি। এরপরও এক সুমহান জাতিতে পরিণত হয়েছিল নবীজির আদর্শ ও চারিত্রিক মাধুর্যকে ধারণ করে। প্রিয়নবী (স.)-এর সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মহান স্রষ্টার ঘোষণা- ‘হে রাসুল, আপনি সর্বোন্নত চারিত্রিক মাধুর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।’ (সুরা আল কলম: ৪)
আরও পড়ুন: নবীজির জীবনী পড়ার উপকারিতা
তাই আমাদেরকেও সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী এই মহামানবের আদর্শে বলিয়ান হতে হবে। উৎপীড়িত-অত্যাচারিত মানুষের প্রকৃত বন্ধু ও দরদিকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে, যেভাবে অনুসরণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সংকটে শান্তির অন্বেষায় দিশাহারা। দেশে দেশে মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ব্যাহত হচ্ছে শান্তি, বাড়ছে সন্ত্রাস—এই মুহূর্তে একমাত্র মহানবী (স.)-এর দেখানো পথ সুন্দরভাবে অনুসরণের মধ্য দিয়ে আমরা এই হানাহানির পথ থেকে সরে আসতে পারি। গড়ে তুলতে পারি এক সুন্দর পৃথিবী।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সব ধরনের নৈরাশ্য ও ফ্যাসাদ বা সন্ত্রাস দূর করতেই ইসলামের আবির্ভাব। এই কঠিন সময় নবী (স.)-এর শিক্ষা ও আদর্শই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে। নবী (স.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় মুক্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ নিহিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সাহাবিদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নবীজি (স.)-এর যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।