ধর্ম ডেস্ক
২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম
শীতের কনকনে ঠাণ্ডা অসহায় মানুষের জন্য এক নীরব বিপর্যয়। এই সময় দান-সদকা কেবল মানবিক সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং ইসলামে এটি বিশেষ মর্যাদা ও অতুলনীয় সওয়াবের আমল। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে শীতকালে দান-সদকার কিছু অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত রয়েছে। নিচে সেগুলো দলিলভিত্তিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
শীতকালে দান-সদকার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো বস্ত্রদান। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে মুমিন কোনো বস্ত্রহীন মুমিনকে পোশাক দান করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন।’ (তিরমিজি: ২৪৪৯) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যখন কোনো মুসলিম অন্য মুসলিমকে পোশাক পরিধান করায়, তখন দানকারী আল্লাহর হেফাজতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত দানকৃত পোশাক ব্যবহার হতে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৮৪)
এই খাতে দান করার সময় উষ্ণ কম্বল বা চাদর, সোয়েটার, জ্যাকেট, শাল, মোজা, টুপি এবং গলাবন্ধনী প্রদান করা উচিত। শিশুদের জন্য আলাদা উষ্ণ পোশাকের ব্যবস্থা করা যায়। বিশেষভাবে ফুটপাথবাসী, ভাসমান মানুষ, উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবার, বৃদ্ধ ও শিশুদের উপর লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। একটি ভালো কম্বলের মূল্য সাধারণত পাঁচশ থেকে বারোশ টাকা, একটি সোয়েটার তিনশ থেকে আটশ টাকা এবং শিশুর পোশাক চারশ থেকে সাতশ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
শীতে ঠাণ্ডার সঙ্গে ক্ষুধা যুক্ত হলে দুর্বল মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তারা আল্লাহর ভালোবাসায় দরিদ্র, এতিম ও বন্দীদের খাদ্য দান করে।’ (সুরা ইনসান: ৮) এই খাতে গরম খাবার যেমন খিচুড়ি ও স্যুপ, শুকনো খাবার প্যাকেট, বিস্কুট, খেজুর এবং গরম পানীয় যেমন চা ও দুধ দান করা উচিত। বিশেষ করে রাত্রিবেলা ও ভোরে যখন ঠাণ্ডার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, তখন খাবার বিতরণ করা বেশি উপকারের। দশ থেকে বিশ পরিবারের জন্য গরম খাবারের ব্যবস্থা এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা এবং পঞ্চাশ থেকে একশ জনের জন্য গরম চা-দুধের ব্যবস্থা তিনশ থেকে আটশ টাকা খরচ হতে পারে।
আরও পড়ুন: কোরআনে প্রশস্ত অন্তরের মানুষের প্রশংসা
শীতজনিত রোগ যেমন নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর- বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মারাত্মক হয়ে ওঠে। রাসুল (স.) বলেন, ‘তিনটি আমল পাপ মোচন করে- সংকটকালে দান, গ্রীষ্মের রোজা ও শীতের অজু।’ (আদ দোয়া লিত তাবরানি: ১৪১৪) এই খাতে চিকিৎসা খরচ, প্রয়োজনীয় ওষুধ, হাসপাতালে দরিদ্র রোগীর জন্য অতিরিক্ত কম্বল, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রমের চিকিৎসা তহবিলে সহায়তা করা যায়। নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় সাধারণত দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা, ওষুধের প্যাকেট পাঁচশ থেকে দেড় হাজার টাকা এবং একটি ভালো কম্বল আটশ থেকে বারোশ টাকা খরচ হতে পারে।
অনেক মানুষ শীতে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ আছে, সে যেন তা অভাবগ্রস্তকে দেয়।’ (মুসলিম: ১৭২৮) এই খাতে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনায় সহায়তা, মসজিদ বা মাদ্রাসায় রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা এবং দুর্গম এলাকায় তাবু বা শেল্টার বিতরণ করা যায়। একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনায় মাসিক পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার টাকা, এক রাতের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থায় দুই থেকে চার হাজার টাকা এবং একটি ভালো তাবু তিন হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে।
আরও পড়ুন: দান-সদকা: দুনিয়াতেই ৯ প্রতিদানের নিশ্চয়তা
শীতের কারণে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যাহত হয়। শিক্ষা অব্যাহত রাখা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এই খাতে স্কুল-মাদ্রাসার গরিব শিক্ষার্থীদের শীতবস্ত্র, হোস্টেলের জন্য কম্বল এবং শিক্ষা উপকরণের সঙ্গে উষ্ণ পোশাক প্রদান করা যায়। একজন শিক্ষার্থীর জন্য পূর্ণ শীতবস্ত্র সেট ছয়শ থেকে এক হাজার টাকা, একটি কম্বল পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা এবং শিক্ষা উপকরণসহ পোশাকের সেট আটশ থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হতে পারে।
গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় অনেক পরিবার জ্বালানির অভাবে শীত নিবারণ করতে পারে না। এই খাতে কাঠ, কয়লা, ব্ল্যাঙ্কেট বা প্রয়োজন অনুযায়ী নিরাপদ উষ্ণতার ব্যবস্থা করা যায়- বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য। একটি পরিবারের জন্য এক সপ্তাহের কাঠ বা কয়লার ব্যবস্থা পাঁচশ থেকে আটশ টাকা, একটি ভালো ব্ল্যাঙ্কেট চারশ থেকে সাতশ টাকা এবং একটি নিরাপদ হিটার দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
শীতকালীন দান শুধু সাময়িক না হয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই খাতে দীর্ঘদিন ব্যবহারযোগ্য মানসম্পন্ন শীতবস্ত্র, ক্ষুদ্র আয়ের উদ্যোগ যেমন চা-স্ন্যাক্স স্টল এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় যাতে পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হতে পারে। একটি ভালো মানের শীতবস্ত্র সেট দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা, একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগের পুঁজি পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার টাকা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তিন হাজার থেকে আট হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে।
আরও পড়ুন: দান-সদকায় মেলে মানসিক প্রশান্তি
দানের অগ্রাধিকার ক্রম হওয়া উচিত: প্রথমে অভাবী নিকটাত্মীয়, তারপর প্রতিবেশী, এরপর স্থানীয় দরিদ্র এবং সর্বশেষে দূরবর্তী এলাকার অসহায়। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মিসকিন সে নয়, যাকে এক দু’ লোকমা ফিরিয়ে দেয় (যথেষ্ট হয়) বরং সে-ই প্রকৃত মিসকিন যার সম্পদ নেই, অথচ সে (চাইতে) লজ্জাবোধ করে অথবা লোকদেরকে আঁকড়ে ধরে যাচ্ঞা করে না।’ (বুখারি: ১৪৭৬) দান করার সময় মানসম্পন্ন সামগ্রী দান, বিশ্বস্ত মাধ্যম নির্বাচন এবং লজ্জাশীল গরিবের ক্ষেত্রে গোপন দানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
শীতের শুরুতে অর্থাৎ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে প্রতিরোধমূলক সহায়তা প্রদান করা উচিত। শীতের তীব্র সময় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সরাসরি সহায়তা করা বেশি জরুরি। রাত্রিবেলা যখন ঠাণ্ডার প্রকোপ সর্বোচ্চ তখন সাহায্য করা বিশেষ সওয়াবের। শুক্রবার সাপ্তাহিক সওয়াব বৃদ্ধির দিন এবং আশহুরুল হুরুম মাসে দান-সদকার ফজিলত আরও বৃদ্ধি পায়।
আজই শুরু করা যায় নিজ উদ্যোগে পরিবারের সাথে বসে তালিকা তৈরি করে কাকে কী দেবেন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে শীতার্ত তহবিলে অংশ নিতে পারেন। বিশ্বস্ত দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে দান করতে পারেন। কর্মস্থলে সহকর্মীদের সাথে যৌথ উদ্যোগ নিতে পারেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্বস্ত উদ্যোগ শেয়ার করে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
শীতকাল দান-সদকার এক সুবর্ণ মৌসুম। একটি কম্বল, একটি গরম খাবার বা সামান্য চিকিৎসা সহায়তা কারো জন্য হতে পারে জীবন বাঁচানোর মাধ্যম, আর দানকারীর জন্য হতে পারে জান্নাতের পাথেয়। স্মরণ রাখতে হবে, একটি কম্বল শুধু শীত দূর করে না; এটি মানুষের হৃদয়েও উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। দানের মাধ্যমে আমরা কেবল অপরের প্রয়োজনই পূরণ করি না; আমাদের নিজের ঈমানও পরিশুদ্ধ হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই শীতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।