images

ইসলাম

শয়তানের শেষ অস্ত্র বিদআত

ধর্ম ডেস্ক

২৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:১০ পিএম

শয়তান মুমিনের প্রকাশ্য শত্রু। বনি আদমকে গোমরাহ করা, মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করা তার মূল কাজ। মানুষের পরীক্ষা গ্রহণের জন্যই আল্লাহ তাআলা অভিশপ্ত শয়তানকে কুকর্ম করার সুযোগ দিয়েছেন। যারা শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণামুক্ত থাকবে তারাই হবে সফলকাম। 

বিদআত শয়তানের শেষ অস্ত্র। এই অস্ত্র দ্বারা শয়তান নবী-রাসুলদের মেহনত ভণ্ডুল করার চেষ্টা করত। কিন্তু শয়তানের সকল ফাঁদ ভেঙ্গে দিয়েছেন যুগে যুগে প্রেরিত পয়গম্বরগণ। তাতেই শয়তান পয়গাম্বরগণের ওপর ভীষণ নাখোশ। সবচেয়ে বেশি নাখোশ রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ওপর। কারণ তিনি শিরক-কুফরকে সমূলে উৎখাত করেই ক্ষান্ত হননি, ঈমান ও আমলের চতুর্দিকে সুন্নতের প্রাচীর প্রতিষ্ঠা করে তাওহিদকে এমন কঠিনভাবে সংরক্ষিত করেছেন যা ইতোপূর্বে কোনো নবী করেননি। 

তবে, শয়তানের একটি সান্ত্বনার জায়গা আছে, সেটি হল তার দীর্ঘকালীন হায়াত। দীর্ঘ হায়াতে সে শিরক-বিদআতকে পুনরুজ্জীবিত করার আশায় রয়েছে। ইতোমধ্যে সে কিছুটা সফল হয়েছে। নবীর শিক্ষাকে বিশ্ব থেকে প্রায়ই বিলীন করেছে। উম্মতকে তাওহিদ ও রিসালাতের পথ থেকে সরিয়ে বিদআত ও শিরকের পথে নিক্ষেপ করেছে। তার প্ররোচনায় মহানবী (স.)-এর উম্মত যখন বিদআতে লিপ্ত হয় তখন সে মানসিক তৃপ্তি বোধ করে। তার আনন্দের সীমা থাকে না।

শয়তান বিদআতকে নাফরমানীর চেয়েও বেশি পছন্দ করে। কোনো মুসলমান জেনা-ব্যভিচার, খুন-খারাবি করলে সে যতটা খুশি হয় তার চেয়ে বেশি খুশি হয় সুন্নত ছেড়ে বিদআতে লিপ্ত হলে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ) বলেন- ‘ইবলিসের নিকট নাফরমানির চেয়েও বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ নাফরমানি থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।’ (শাতিবি, আলইতিসাম: ১/১১; ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা পৃ-১৯)

আরও পড়ুন: নামাজের মধ্যেও মানুষ শিরক করে যেভাবে

তবে, কেউ যদি শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তাঁরই নির্দেশনা অনুযায়ী নবীর পথে অটল অবিচল থাকে, তাহলে শয়তানের খপ্পর থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব। মুমিনদের সঙ্গে মহান আল্লাহর খাস রহমত বিদ্যমান আছে। তাই এখনও অনেক মুমিন বিদআতকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে। যদি এই রহমত না থাকত তাহলে বহু আগেই তারা বিদআতের আবর্তে দ্বীন ও ঈমান থেকে বঞ্চিত হত।

মুসলিম সমাজে বিদআত চালু করার পেছনে শয়তানের জঘন্য মনোবৃত্তি কার্যকর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, عن أبي بكر الصديق رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال : إن إبليس قال أهلكتهم بالذنوب فأهلكوني بالاستغفار، فلما رأيت ذلك أهلكتهم بالأهواء فهم يحسبون أنهم مهتدون فلا يستغفرون. رواه ابن أبي عاصم ‘আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ইবলিস বলে, আমি বনি আদমকে বরবাদ করছিলাম তাদেরকে গুনাহে পতিত করার দ্বারা। আর তারা আমার সকল মেহনত বরবাদ করে দেয় ইস্তেগফার করার দ্বারা। যখন দেখলাম আমি ঠকে যাচ্ছি তখন ভিন্ন পদ্ধতি শুরু করলাম। এখন আমি তাদের বরবাদ করছি বিদআতে লিপ্ত করার দ্বারা। তারা এটিকে নেক আমল জ্ঞান করে নিজেদেরকে হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করছে। ফলে এখন তারা ইস্তেগফারের চিন্তাও করে না।’

আরও পড়ুন: বিদআত কেন প্রত্যাখ্যাত, পরিণাম কী?

দুঃখজনক হলেও সত্য- অনেকে বিদআতকে সামান্য বিষয় মনে করে। অথচ তা শয়তানের নিকৃষ্ট কারসাজি। কাজটি সামান্য বলে দেখিয়ে তা সম্পাদনের রাস্তা তৈরি করে শয়তান। তারপর সে কাজের মাধ্যমে সে নিজের মনস্কামনা পূর্ণ করে নেয়। মহানবী (স.) উম্মতকে এই কারসাজির কথাও জানিয়ে দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, শয়তান তোমাদের ভূখণ্ডের মূর্তিপূজা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণভাবে নিরাশ থাকে। তবে সে আশাবাদী মূর্তিপূজা ছাড়া অন্যান্য এমন বিদআত কাজ সম্পর্কে যেগুলোকে তোমরা সামান্যজ্ঞান করবে। কাজেই সাবধান! সামান্য দেখিয়ে সে যেন তোমাদেরকে বিদআতের অনুসরণ করাতে না পারে। আমি তোমাদের জন্য এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা সে জিনিস দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো তাহলে কখনও গোমরাহ হবে না। তা হলো মহান আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত। (মুনজিরি; আততারগিব ওয়াত তারহিব: ৬৩)

আরও পড়ুন: বিদআতি লোককে আশ্রয়দাতার ব্যাপারে যা বলেছেন নবীজি (স.)

বিদআত হল শিরকের জন্মদাতা। পৃথিবীতে যুগে যুগে যত শিরকের উৎপত্তি ঘটেছে তার সবগুলোই বিদআত থেকে সৃষ্ট। তাই বিদআতের পরিণতি হল শিরক। বিদআত সুন্নতের সংহারক, সুন্নত দখলকারী, শরিয়ত বিকৃতির গোপন পথ। এই গোপন পথেই শয়তান মানুষকে শিরকের আস্তানায় নিয়ে যায়। এসব কারণে আল্লাহর নিকট অন্যতম নিকৃষ্ট কাজ হলো বিদআত। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বিদআতের উপরোক্ত হাকিকত স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট যেসব কাজ নিকৃষ্ট বিবেচিত তন্মধ্যে অন্যতম হল বিদআত করা। (ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা, পৃ-১৭)

সাহাবিদের সকলে বিদআতকে খুবই মন্দ ও অতিশয় নিকৃষ্ট কাজ বলে জানতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সফরের নামাজ হল দু’রাকাত। যে সুন্নতের খেলাফ করল সে যেন কুফরি করল। (আলইতিসাম: ১/১০৯)

ইমাম শাতেবি বলেন, লক্ষণীয় যে, সাহাবি ইবনে ওমর (রা.) সফরে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু’রাকাতের পরিবর্তে পূর্ণ চার রাকাত পড়াকে কুফরির মতো মন্দ জিনিস বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, কোনো কাজ যদি নামাজের মতো নিরেট ভালো জিনিসও হয় আর সেটা যদি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর তরিকামতো সম্পাদিত না হয় তাহলে সে কাজের দ্বারা সওয়াব আশা করা যায় না। বরং সেটি খেলাফে সুন্নত ও বিদআত হওয়ার কারণে সবচেয়ে মন্দ কর্ম বলে বিবেচিত হবে। 

আরও পড়ুন: নামাজ না পড়া শিরক, না কুফরি?

খেলাফে সুন্নতকে পছন্দ করার মধ্যে প্রকারান্তরে সুন্নতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন ঘটে। এ কারণে সাহাবিগণ খেলাফে সুন্নতকে কুফরির মতো খারাপ বলে বোধ করতেন। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, তোমরা যদি নিজ নিজ গৃহে নামাজ পড়তে থাক এবং মসজিদে আসা বাদ দাও তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর সুন্নত পরিত্যাগ করলে। আর তোমাদের নিজ নবীর সুন্নত পরিত্যাগ করে তার খেলাফ কিছু করা মানে তার সাথে কুফরি করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিদআত-শিরক থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। প্রত্যেক ইবাদত নবীজি (স.)-এর সুন্নত অনুযায়ী করার তাওফিক দান করুন। সুন্নতের ওপর জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।