images

ইসলাম

ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রভাব ঘরে ঘরে, বাঁচার আমল

মো. মারুফুল আলম

২৬ জুলাই ২০২৩, ০৫:২৩ পিএম

ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদু হলো এক ধরনের ধ্বংসাত্মক চর্চা যা অন্যের অনিষ্ট সাধনে কিংবা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে করা হয়। এতে অতি মানবীয় সংশ্লিষ্টতা তথা দুষ্টু জ্বিন-পরী ও শয়তানের আশ্রয় নেওয়া হয় অথবা কুফুরি কালাম পাঠ করা হয়। কালো জাদুর ইতিহাস অনেক পুরনো। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ পাওয়া দুষ্কর যেখানে কালো জাদু বা অন্ধকার জাদুর চর্চা হয় না। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। কালো জাদুতে আক্রান্ত, ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রভাব, দোয়া ও আমল, কালো যাদু থেকে বাঁচার উপায়

সাম্প্রতিক সময়ে কালো জাদুর চর্চা ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে বলে আলেমরা মনে করছেন এবং এ থেকে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে শরিয়তঅনুমোদিত উপায়গুলো তুলে ধরছেন। ইসলামে কালোজাদু তথা ক্ষতিকর জাদুটোনা হারাম এবং কুফরি কাজ। যা ইমানকে ধ্বংস করে দেয়। কেউ যদি জেনে-বুঝে কারও ওপর ক্ষতিকর এই জাদু করে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। ইসলামের ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে জাদুটোনার শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।

কালো জাদুর ক্ষতিকর প্রভাব সুস্থ-সবল মানুষকে এমনকি একটি পরিবারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। এর প্রভাবে অনেক রকম ক্ষতি হয়। অসুখ-বিসুখ লেগে থাকা, ওষুধে কাজ না হওয়া, ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ করা, চাকরি-ব্যবসা না হওয়া বা বেকার থাকা, শত্রু বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে কালো জাদুর প্রভাবে। 

আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই কালো জাদুর অস্থিত্ব বিলীন করে দেননি, যেমনটি বিলীন করেননি শয়তানের সওয়ার হওয়ার শক্তি, বদনজর কিংবা নফসের শয়তানীসহ ইত্যাদি ক্ষতিকর দিকগুলো। আলেমদের মতে, নিশ্চয়ই এতে কোনো হেকমত লুকিয়ে আছে।

সাধারণত কালো জাদুতে মরিচ, লেবু, পুতুল, সুঁই, মানুষের চুল, নখ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ইসলামে কালো জাদুর প্রভাব থেকে বেঁচে থাকার নানা উপায় ও দোয়া বর্ণিত হয়েছে। কালো জাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করাসহ উপায়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

কালো জাদুতে আক্রান্ত—সনাক্ত করার উপায়
জাদুগ্রস্ত বা দুষ্টু জ্বিনের প্রভাব বোঝার মৌলিক একটি উপায় হলো- সে কোরআনের তেলাওয়াত সহ্য করতে পারে না। তেলাওয়াতের সময় সে চটফট করে, বিভিন্নভাবে তেলাওয়াত বন্ধ করার চেষ্টা করে, অনেক সময় তার আঙ্গুল পর্যন্ত বাঁকা হয়ে যায়। এছাড়াও জাদুগ্রস্ত ব্যক্তি দিনদিন শুকিয়ে যায়, খেতে পারে না, বাসা থেকে বের হতে পারে না। অথচ তার মধ্যে কোনো অসুখ নেই। জ্বিন সওয়ার হওয়ার আলামতগুলোর মধ্যে মৌলিক কিছু আলামত হলো- মাত্রাতিরিক্ত হাই তোলা, ঝিমুনি আসা। এছাড়াও চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকাসহ আরও অনেক আলামত রয়েছে। বাচ্চারা অস্বাভাবিক আচরণ করে। যারা শরয়ি ঝাড়ফুঁক করেন, তারা আরও আলামত বলতে পারবেন।

জাদুটোনা থেকে বাঁচার আমল
জাদুটোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যদি জানা যায় যে, জাদুকর কিছু চুল নির্দিষ্ট কোনো স্থানে অথবা চিরুনির মধ্যে অথবা অন্য কোনো স্থানে রেখে দিয়েছে। যদি স্থানটি জানা যায়— তাহলে সে জিনিসটি পুড়িয়ে ফেলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে; যাতে জাদুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়, জাদুকর যা করতে চেয়েছে— সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঝাড়ফুঁক করতে হবে।

ঝাড়ফুঁকের পদ্ধতি
জাদুতে আক্রান্ত রোগীকে আয়াতুল কুরসি অথবা সুরা আরাফ, সুরা ইউনুস, সুরা ত্বহার জাদুবিষয়ক আয়াতগুলো পড়ে ফুঁ দেবেন। এগুলোর সাথে সুরা কাফিরুন, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়বেন এবং রোগীর জন্য দোয়া করবেন। গুরুত্বপূর্ণ একটি দোয়া হলো— اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ أَذْهِبْ الْبَاسَ اشْفِهِ وَأَنْتَ الشَّافِي لَا شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لَا يُغَادِرُ سَقَمًا উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাব্বান নাসি উজহিবাল বা’সি, ইশফিহি ওয়া আনতাশ-শাফি, লা শিফায়া ইল্লা শিফায়ুকা শিফায়ান লা ইউগাদিরু সাকমা। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! মানুষের প্রতিপালক, কষ্ট দূরকারী। আমাকে আরোগ্য দিন, আপনি আরোগ্যকারী—আপনি ছাড়া কোনো আরোগ্যকারী নেই। এমন আরোগ্য দিন যেন কোনো রোগ না থাকে।’ আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) এই দোয়া পড়ে অসুস্থ ব্যক্তিদের ঝাড়ফুঁক করতেন। (বুখারি: ৫৭৪২)

অথবা জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নবী (স.)-কে যে দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করেছেন— সেটাও পড়া যেতে পারে। সে দোয়াটি হলো- بِسْمِ الله أرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ، بِسمِ اللهِ أُرقِيكَ উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি আরক্বিক মিন কুল্লি শাইয়িন য়ুযিক। ওয়া মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন হাসিদিন; আল্লাহু ইয়াশফিক। বিসমিল্লাহি আরক্বিক। অর্থ: আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। সকল কষ্টদায়ক বিষয় থেকে। প্রত্যেক আত্মা ও ঈর্ষাপরায়ণ চক্ষুর অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। (মুসলিম: ২১৮৬; তিরমিজি: ৯৭২)

উল্লেখিত দোয়াটি তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন। এছাড়াও সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন। অথবা যে দোয়াগুলো উল্লেখ করা হলো সেগুলো পড়ে পানিতে ফুঁ দেবেন। এরপর জাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তি সে পানি পান করবে। আর অবশিষ্ট পানি দিয়ে প্রয়োজনমতো একবার বা একাধিক বার গোসল করবে। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করবে। আলেমগণ এ আমলগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। শাইখ আব্দুর রহমান বিন হাসান (রহ) ‘ফাতহুল মাজিদ শারহু কিতাবিত তাওহিদ’ গ্রন্থের ‘নাশরা অধ্যায়ে’ এ বিষয়গুলো ও আরও কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন।

বাচ্চাদেরকে জাদুটোনা থেকে রক্ষার কার্যকরী দোয়া
 أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ উচ্চারণ: আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শায়তানিন, ওয়া হাম্মাতিন, ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাতিন। অর্থ: ‘আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ কলেমার দ্বারা প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং প্রত্যেক কুদৃষ্টির অনিষ্ট থেকে আশ্রয় কামনা করছি।’ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (স.) এই দোয়ার মাধ্যমে হাসান ও হুসাইন (রা.)-এর জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, এই দোয়ার মাধ্যমে তোমাদের পিতা [ইবরাহিম (আ.)] ইসমাঈল ও ইসহাকের জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। (সহিহ বুখারি: ৩৩৭১)

এ সংক্রান্ত আরেকটি দোয়া হলো—بِسْمِ اللهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ  বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা-ই ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম। অর্থ: ‘আল্লাহ তাআলার নামে, যার নামের বরকতে আকাশ ও মাটির কোনো কিছুই কোনো অনিষ্ট করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ উসমান বিন আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার এই দোয়া পড়বে, আল্লাহ তাআলা তাকে সব ধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন। অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহ তাআলা তাকে সব ধরনের রোগব্যাধি থেকে হেফাজত করবেন। (তিরমিজি: ৩৩৮৮)

জাদুটোনা দূর করার চিকিৎসা
সাতটি কাঁচা বরই পাতা সংগ্রহ করে পাতাগুলো গুড়া করবে। এরপর গুড়াগুলো পানিতে মিশিয়ে সে পানিতে উপরে উল্লেখিত আয়াত ও দোয়াগুলো পড়ে ফুঁ দিবে। তারপর সে পানি পান করবে; আর কিছু পানি দিয়ে গোসল করবে। যদি কোনো পুরুষকে স্ত্রী-সহবাস থেকে অক্ষম করে রাখা হয় সেক্ষেত্রেও এ আমলটি উপকারী। বরই পাতার পানিতে যে আয়াত ও দোয়াগুলো পড়তে হবে সেগুলো নিম্নরূপ:

১. সুরা ফাতিহা পড়া। ২. আয়াতুল কুরসি পড়া। ৩. সুরা আরাফের ১০৬ নম্বর আয়াত থেকে ১২২ নম্বর পর্যন্ত মোট ১৭টি আয়াত পড়া। অর্থাৎ قَالَ إِنْ كُنْتَ جِئْتَ بِآيَةٍ فَأْتِ بِهَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ এই আয়াত থেকে رَبِّ مُوسَى وَهَارُونَ পর্যন্ত  জাদু বিষয়ক আয়াতগুলো পড়া। ৪. সুরা ইউনুসের ৭৯ নম্বর আয়াত থেকে ৮১ পর্যন্ত জাদুবিষয়ক আয়াতগুলো পড়া। ৫. সুরা ত্বহার ৬৫ নম্বর আয়াত থেকে ৬৯ পর্যন্ত আয়াতগুলো পড়া। ৬. সুরা কাফিরুন পড়া। ৭. সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস ৩ বার করে পড়া। ৮. বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়া। কালো জাদু, ব্ল্যাক ম্যাজিক, দোয়া ও আমল

যাদের ওপর জাদুর প্রভাব পড়ে না, খারাপ জ্বিন সওয়ার হতে পারে না
আমাদের জীবনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কালো ম্যাজিকের ভয়াল থাবা রয়েছে। আরও রয়েছে খারাপ জ্বিনের অত্যাচার, বদনজর ইত্যাদি। এসব ক্ষতি থেকে কিছু মানুষ সার্বক্ষণিক বেঁচে থাকেন। তারা কারা? তারা হলেন প্রকৃত মুমিন। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং সকাল-সন্ধ্যার মাসনুন দোয়াগুলো পড়েন। ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস তিনবার করে পড়েন। এছাড়াও ঘরে প্রবেশ ও বের হওয়ার দোয়া, টয়লেটে প্রবেশ ও বের হওয়ার দোয়া, খাওয়া-দাওয়ার দোয়াসহ দৈনন্দিন দোয়াগুলোর ওপর আমল করেন। এসব কারণে তাদের ওপর জাদুর প্রভাব পড়ে না, খারাপ জ্বিন-পরীও সওয়ার হতে পারে না। যদি কারো বাসায় দুষ্ট জ্বিনের আসর থাকে, সুরা বাকারা পড়তে হবে। এতে দুষ্ট জ্বিন পালিয়ে যাবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন ও হাদিসের বর্ণিত আমলের মাধ্যমে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন। জাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তি চেনার উপায়