images

মতামত

আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকেরা

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫২ পিএম

আমি ভাগ্যগুণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হয়েছিলাম। বিষয়টি অবিশ্বাস্য হলেও শতভাগ সত্য। ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি খ ইউনিটের ফর্ম পূরণ করি এবং ৬ জানুয়ারি কলাভবনের ডিন অফিসে তা জমা দিই। ভর্তি পরীক্ষা জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর ফলাফল প্রকাশিত হয় ২৮ মার্চ।

ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট জেনেছিলাম বন্ধু তানভীরের মাধ্যমে। আমার রেজাল্ট দেখে রাতে সে আমাকে একটি চিঠি লিখে এবং সকালে তা পোস্ট করার জন্য রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে যায়। চিঠি পোস্ট করার আগে কি যেন মনে করে সে আবারও আমার ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখে। তখন আগের চিঠি ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে একটি চিঠি লিখে জানায়, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়েছি। তানভীর সেদিন যদি পরীক্ষার ফলাফল পুনরায় না দেখতো তাহলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতাম না।

‘খ’ ইউনিটে আমার রোল ছিল ২৫৮৭৮। মেরিট লিস্টে সিরিয়াল ছিল ১০০০ এর কাছে বা পরে। ইচ্ছে ছিল আইআর, পাবলিক এড, জার্নালিজম, সমাজবিজ্ঞান বা সমাজকল্যাণে পড়ব। কিন্তু মেধাক্রমে পিছিয়ে থাকায় সে আশা ভেস্তে গেল।

আরও পড়ুন

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: পদক্ষেপ ও সমাধান
কী অবস্থা তরুণ প্রজন্মের, কী-ই বা তাদের প্রত্যাশা

মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার ভাইভা পরীক্ষার তারিখ ছিল। কোন বিষয়ে অনার্স পড়াশোনা করব দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু মামুন আশরাফ পরামর্শ দিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভর্তি হতে।

এসএসসিতে পৌরনীতি থাকলেও ইন্টারে ছিল না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা খুব বেশি ছিল না।

ভর্তির ভাইভা পরীক্ষা ছিল দুপুরের পর। কলা অনুষদের ডিন অফিসে। পরীক্ষা বলা ঠিক হবে না। শুধু সাবজেক্ট চয়েজ, সিট থাকলে ও শর্তপূরণ হলে সাবজেক্ট বরাদ্দ দেওয়া। ভাইভা বোর্ডে কারা ছিলেন তা মনে নেই। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোন সাবজেক্টে পড়তে চাই। যে বিষয়গুলো ছিল তার থেকে আমি ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ বেছে নিলাম। অর্থাৎ পলিটিক্যাল স্যাইন্স ডিপার্টমেন্ট হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ঠিকানা।

ডিন অফিসের কাজ শেষ। এরপর সবকিছু ডিপার্টমেন্ট ও আবাসিক হলে। ভাইভা পরীক্ষা দেওয়ার ২/১ দিন পর গেলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অফিসে, ভর্তি ফর্ম আনতে। তখন বিভাগীয় অফিস ছিল বর্তমান কলাভবনের নিচতলার উত্তর-পূর্ব দিকে। এই ভবনের উত্তর গেট দিয়ে ঢুঁকেই ঠিক বাম পাশে। ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে নীলক্ষেত এলাকার নতুন কলাভবন উদ্বোধন হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ঠাঁই হয় সেখানে। এর আগে শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত বর্তমানে কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের (সায়েন্স এনেক্স ভবন) নিচতলার কোণে।

আমরা অনেকেই জানি পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানীর জন্য ঢাকায় একটি সেক্রেটারিয়েট ভবন তৈরি করা হয়। বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজটিই সেই প্রশাসনিক ভবন। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে এটির প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে ১৯১৩ সালে এর কয়েকটি কক্ষে ঢাকা যাদুঘর স্থাপিত হয়। অতঃপর ১৯১৭ সালে এখানে ঢাকা কলেজের মুসলিম ছাত্রদের ছাত্রাবাস স্থাপিত হলো সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এর সামান্য সংস্কার করে ভবনটির নিচতলাকে পরিণত করা হয় আর্টস ফ্যাকাল্টিতে। দ্বিতীয়তলা রূপান্তরিত হয় মুসলিম হল নামে। আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ক্লাস হতো ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণ কোনার ভবনে যা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত। গেট দিয়ে ঢুকেই ডানে আমতলার পাশে টিনের ছাদওয়ালা মধুর ক্যান্টিন এবং সোজা গিয়ে মুখোমুখি ভবনটা ছিল আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ কলাভবনটিকে সামরিক হাসপাতালে পরিণত করা হয়। কলাভবন সরে এলো কার্জন হল এলাকার ক্যাফেটরিয়ার সামনে ভূগোল বিভাগের ক্ষুদ্রাকার গৃহটিতে (তখন একতলা ছিল) এবং ফজলুল হক হল প্রভোস্টের বাসগৃহের সামনের বর্তমান সিএন্ডবি বিভাগের ত্রিতল প্রশাসনিক দফতর ভবনটিতে।

সকাল ১০টা বা সাড়ে দশটা হবে। আমার মতো আরও কয়েকজন এসেছে ভর্তি ফর্ম নিতে। তখন অফিসে পেলাম ইলিয়াস ভাইকে। যদিও তখন তার নাম জানা ছিল না। ভর্তি ফর্ম চাইলে তিনি কয়েকদিন পরে যোগাযোগ করার কথা বলেন। আমরা তাকে বললাম অনেকেই তো ইতোমধ্যে ফর্ম নিয়ে গেছে। আমাদের দিবেন না কেন? তিনি অস্বীকার করলেন। এক কথা, দু’কথায় ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে সামান্য বচসা লেগে গেল। আমার কাছে তিনি বাড়ি ও কোন হলে থাকি জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘ও, এজন্যই তো....।’ কবি জসিমউদদীন হলে একসময় নড়াইল বা যশোরের ছাত্রদের আধিপত্য ছিল। পরে জেনেছি ইলিয়াস ভাইয়ের বাড়ি ছিল নড়াইলে। একসময়ে তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের পরও তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো। আমার সাথে দেখা হলেই বলতেন ‘প্রফেসর সাব, কেমন আছেন?’ কারোনার আগে তার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল তিনি করোনায় মারা যান। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন ইলিয়াস ভাই।

সেদিন আর ভর্তি ফর্ম পেলাম না। ফিরে গেলাম হলে এবং পরে তা সংগ্রহ করেছিলাম। এই ফর্ম বিতরণ দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন ও আব্দুল লতিফ স্যার। ফর্ম পূরণ করে প্রভোস্ট অফিস জমা দিয়ে আসি। সেই সাথে টাকা জমার এক কপি রশিদ। টিএসসির জনতা ব্যাংকে সেই ভর্তির জন্য সর্বমোট ৪৯২ টাকা জমা দিয়েছিলাম। ৪৯২ টাকার মধ্যে ভর্তি ফি ১৫, বেতন ১২০ (১২ মাস), হল ইউনিয়ন চাঁদা ১৬, বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়ন চাঁদা ১০, বিশ্ববিদ্যালয় খেলাধুলা চাঁদা ১০, হল খেলাধুলা চাঁদা ১৫, আবাসিক পরিদর্শন ফি ১, জামানতি টাকা (গ্রন্থাগার) ১৫, পরীক্ষা ফি (কোর্স) ৯০, পরীক্ষা ফি (সাবসিডিয়ারি) ১০০, বিশ্ববিদ্যালয় নিবন্ধন ফি ৫০, ছাত্র/ছাত্রী কল্যাণ ফি ২, রোভার স্কাউট ও রেঞ্জার ফি ২, ভর্তি ফরম ফি ১, পরিচয়পত্র ফি ৪, রশিদ বহি ফি ১, হেলথ কার্ড ফি ৩০ টাকা।

ভর্তির সময় আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর ড চৌধুরী শামসুল হুদা হারুন (১৬/৬/৮৮-১৫/৬/৯১)। তিনি ১৯৭২-৭৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। দেখতে দীর্ঘাকার ও ফর্সা, যেন নায়কের মতো। কেউ কেউ বলতেন তিনি নায়ক ছিলেন। চলাফেরায়, চলন-বলনে ভাবগাম্ভীর্যের অধিকারী ছিলেন। মাস্টার্সে তিনি আমাদের গ্রুপে Bangladesh Politics (Course 403) পড়াতেন। রাজনীতি করতেন এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। স্যারের লেখা বই ‘Bangladesh Voting Behaviour: A Psephological Study’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি নির্বাচনতত্ত্ববিদ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। রয়েল ইউনিভার্সিটির ভিসি ছিলেন এবং ২০০৮ সালের ৪ অক্টোবর ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

আমাদের ১৯৮৯-৯০ সেশনে অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম বর্ষে দুটি গ্রুপ ছিল— A ও B। আমি B গ্রুপে ছিলাম। ওই সময় অনার্সের সাবজেক্টের পাশাপাশি সাবসিডিয়ারি দুটি বিষয় নিতে হতো। আমার সাবসিডিয়ারি ছিল সমাজবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। সাবসিডিয়ারিতে শুধু পাস করলেই চলতো।

আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের ১৬ জুন। প্রথম বর্ষে অনার্সে ‘Western Political Though’ নামে একটি কোর্স ছিল। আমাদের গ্রুপে পড়াতেন সরদার ফজলুল করিম স্যার। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। ছোটখাট চেহারার নিপাট এক ভদ্র মানুষ। হালকা পাতলা গড়ন, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকত। প্রথম দর্শনে তেমন চমক ছিল না। তার জ্ঞানের গভীরতা, উপস্থাপনার নাটকিয়তা, বলার ভঙ্গিতে নতুনত্ব অচিরেই আমাদের মুগ্ধ করে। শুধু তাই নয়, ক্রমেই বুঝতে পারি তার নিজের জীবনটাই একটা নতুন দর্শনের খোরাক। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন। রাজনীতির জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। বামপন্থী ছিলেন। রাজবন্দি হিসেবে দীর্ঘ ১১ বৎসর বিভিন্ন পর্যায়ে কারাভোগ করেন। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৫৪ সনে তিনি পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আহবানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিলেও শিক্ষকতা থেকে অবসর নিতে পারেননি। ১৯৯১/৯২ সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তিনি আমাদের সবসময় বলতেন, ‘ভাব, চিন্তা কর, অনুসন্ধান কর, খোঁজ।’ তিনি আরও বলতেন, ‘চিন্তাকে, চিন্তা ছাড়া, চিন্তা করা অচিন্তনীয়।’ প্লেটোর ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ পড়াতে গিয়ে বলেন ‘Ideal is more real than the real.’ ২০১১ সালে জুনে বাংলাদেশ সরকার সরদার ফজলুল করিমকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করে। এ ছাড়াও বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারসহ জীবদ্দশায় বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অসংখ্য পুস্তক রচনা ও অনুবাদ করেছেন। সারাজীবন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী সরদার স্যার সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন হলেও বিশ্বাস করতেন কোনো ব্যবস্থাই স্থায়ী নয়। তিনি এও মনে করতেন, হাজার বছর পর হলেও সমাজতন্ত্র আবার ফিরে আসবে। কিংবদন্তী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার সরদার ফজলুল করিম ২০১৪ সালের ১৫ জুন ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান৷

A গ্রুপে ‘Western Political Thought (পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রচিন্তা)’ কোর্সটি নিতেন সৈয়দ মকসুদ আলী স্যার। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান (১৯৮১-৮৪) বিভাগের চেয়ারম্যান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ছিলেন। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া অধ্যাপক আলী ঢাবির ছাত্রজীবন থেকেই সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। অত্যন্ত অমায়িক ও আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিলো। তিনি ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট নুরুননাহার ফয়জননেসার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সম্প্রতি স্যারের বিয়ের দাওয়াতপত্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হালকা বাদামি কাগজে সাদামাটা লেখা। কিন্তু অনন্য লেখনী এবং আন্তরিক ও কাব্যিক আমন্ত্রণের কারণে তা ৭১ বছর পর ভাইরাল হয়। স্যারের সহধর্মিণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত সিন্ডিকেট এবং জাতীয় বেতন কমিশনের প্রথম নারী সদস্য। আইইআরের অধ্যাপক এবং রোকেয়া হলের প্রভোস্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন নুরুননাহার ফয়জননেসা। ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপক সৈয়দ মকসুদ আলীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য সৈয়দ সাদ আন্দালিব এবং ছোট ছেলে জিয়া আরাস্তু সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। আর বড় মেয়ে সাদিয়া আফরিন মল্লিক বাংলাদেশের বিখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং অপর কন্যা ছড়াকার ও লেখক নাজিয়া জাবীন। নাজিয়া দৃষ্টিহীনদেরকে নতুন জীবন দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংস্থা । এই সংগঠনের তিনি প্রেসিডেন্ট। এস এম আলী স্যার ৮৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে ইন্তেকাল করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে শেরেবাংলা স্বর্ণপদক লাভ করেন।

সেকেন্ড ইয়ারে সাবসিডিয়ারি ৪টি কোর্স ছিলো। আর অনার্সের ২টি কোর্স হলো- Political Theory & Organization ( Course no. 202) এবং Major Political System UK, USA, USSR & China (Course no. 203) । ২০২ রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সংগঠন পড়াতেন অধ্যাপক একেএম শামসুল হক স্যার। তিনি অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের একজন শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি দরদি ছিলেন। শুনেছি তিনি একসময় মাগুরা জেলার শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। টিটু ও মিঠু স্যারের দুটি জমজ পুত্র সন্তান আছে। তার গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার কালকিনিতে। তিনি ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ৮০ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন।

‘A’ গ্রুপে এই কোর্সটি নিতেন মুন্সি স্যার। পুরো নাম এম শহীদুল হক মুন্সি। মুজিবনগর সরকারে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ঝড়ের বেগে ইংরেজিতে লেকচার দিতেন। স্যারের একটা উক্তি ছিলো, ‘জানার কোনো শেষ নেই, এতো জেনে কী করবেন, তাই তো কিছুই জানতে চান না।’ স্যারের বাড়ি গোপালগঞ্জে। ১৯৬৪ সালে ঢাবি থেকে এমএ পাস করেন এবং সম্ভবত নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আমার যদি ভুল না হয় তবে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সংগঠন কোর্সে পরিসংখ্যান অংশটি নিতেন অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন ম্যাডাম। তিনি ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৮২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ১৯৮৭ সালের ১২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৩ সালের ৩ মার্চ অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করেছেন ১৯৯৬ সালে। ম্যাডাম বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বেশ কয়েক বছর শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগেও শিক্ষকতা করেন। তিনি এমাজউদ্দীন আহমদ স্যারের মেয়ে। অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান (১৬/৬/৯১–৩১/১২/৯২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (১৩/১২/১৯৮৬-১২/১২/১৯৯০) এবং উপাচার্য (০১/১১/১৯৯২– ৩১/৮/১৯৯৬) হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) ভিসিও ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তার ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু তার বহু বক্তব্য শুনেছি। তিনি অত্যন্ত সুমিষ্ট ভাষায় এবং চমৎকার শান্ত মেজাজে ভাষণ দিতেন। আজও তার কথাগুলো কানে বাজে। এমাজউদ্দিন স্যার সর্বদা বলতেন, ‘বাপু, বড্ড ভালোবাসি তোমাদের, তোমরা আমার সন্তান সমতুল্য সোনার ছেলে, আদরের ছেলে। আমার হৃদয় মাঝে তোমাদের স্থান অনেক বড় এবং শক্ত।’ স্যার ১৯৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ভারতের মালদহে জন্মগ্রহণ করেন। চাপাই নবাবগঞ্জ সদরে গোহাল বাড়ি এলাকায় পরিবারসহ দীর্ঘদিন বসবাস করেন প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে তিনি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। এই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ২০২০ সালের ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

Major Political System UK, USA, USSR & China (Course no: 203) কোর্সের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন মোল্লা। তিনি বেশ ভালো ক্লাস নিতেন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন হয়। এজন্য USSR পড়াননি। মোল্লা স্যার ঢাবি থেকে এমএ করেন এবং ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ‘গিয়াসউদ্দিন মোল্লা ও ফয়জুন্নেছা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন। উল্লেখ্য, ড. গিয়াসউদ্দিন মোল্লার স্ত্রী মিসেস ফয়জুন্নেছা বেগম সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশকে কীভাবে বাঁচাবো মোরা
নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার ও অপব্যবহার

থার্ড ইয়ারে অনার্সে ৪টি কোর্স ছিল— ১. International Politics (Course no. 204), ২. Political Development in Bangladesh (Course no. 205) ৩. Public Administration in Bangladesh (Course no. 206) এবং ৪. Oriental Political Though (Course no. 212). আন্তর্জাতিক রাজনীতি (কোর্স ২০৪) ক্লাস নিতেন ফেরদৌস হোসেন স্যার। টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী ফেরদৌস স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে বিএসএস ( সম্মান) এবং ১৯৭৯ সালে এমএসএস করেন। তারপর ১৯৮৩ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালের ২ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। আমরা তাকে বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ফেরদৌস স্যার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। সেইসাথে ২৫/১১/২০০১ থেকে ২৪/১১/২০০৭ পর্যন্ত স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রফেসর ফেরদৌস হোসেন ২০১৯ সালের ৩০ জুন থেকে ২৯ জুন ২০২২ পর্যন্ত বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ক্লাসে স্যারের প্রাঞ্জল ভাষায় লেকচার আর টকশোতে অসাধারণ যুক্তিতর্ক মনে থাকবে চিরদিন। সাদা দলের সমর্থক হলেও তিনি দলরাজনীতির কক্টরপন্থী ছিলেন না। বলা যায় স্পষ্টবাদী একজন শিক্ষক। স্যারের ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করতো। অন্য গ্রুপের ছাত্ররাও স্যারের ক্লাস করতে আসতো। ১৯৮২ সালের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সরকারি চাকরিতে যাননি। আমাদের গ্যাট চুক্তি ও এর প্রভাবের একটি অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন (কোর্স নং ২০৫) বিষয়ের ক্লাস নিতেন দুজন শিক্ষক। ১৭৫৭-১৯৪৭ পর্যন্ত পড়াতেন রাজিয়া বানু ম্যাডাম অর্থাৎ অধ্যাপক ড. ইউএবি রাজিয়া আক্তার বানু। ছাত্রজীবনে তার সাথে কখনও কথা হয়নি। একবার একটি কলেজের নিয়োগ পরীক্ষায় আমি অংশগ্রহণ করি। তিনি এক্সপার্ট ছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, নিয়োগ পেলে কলেজের কাছাকাছি থাকতে হবে। আমি রাজি হইনি বলে তিনি আমাকে ভাইভায় কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত করেননি সেদিন। ঢাকায় ফিরে আসার পথে একই মাইক্রোবাসে এসেছিলাম। তিনি আমার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল শুনে বলেছিলেন, তুমি তো জাপানে যেতে পারতে। ওই কলেজে আমাদের বন্ধু প্রয়াত আব্দুল খালেক নিয়োগ পেয়েছিল। রাজিয়া বানু ম্যাডাম ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলার সানিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে শুরু করেন শিক্ষকতা পেশা। ১৯৯৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। পেশাগত জীবনে শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট এবং বিআইআইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। তার লেখা বেশকিছু বই ও প্রবন্ধ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তার রচিত ‘ইসলাম ইন বাংলাদেশ’ বইটি বাংলাদেশের মানুষের মনের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির একটি অনবদ্য কাব্য। তার পুরো জীবন ও কর্ম ছিল বর্ণাঢ্যময়। দেশের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ড. ইউএবি রাজিয়া আক্তার বানু ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি আমাদের বিভাগের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান স্যারের সহধর্মিণী ছিলেন। তবে আমি তালুকদার মনিরুজ্জামান স্যারের কোনো ক্লাস পাইনি। মাস্টার্সে আমার অনেক বন্ধু Military and Politics : Third World Countries (Course No. 405) কোর্স নিয়েছিল। তিনি এই কোর্সটি নিতেন। এটি অপশনাল ছিলো। আমি মাঝে মধ্যে স্যারের ক্লাস করতাম। স্যার তখন বেশ সিনিয়র। খুব নিচু স্বরে কথা বলতেন। ক্লাসে সবাই চুপ না থাকলে ওনার লেকচার শোনাই যেতো না। অনেক সময় লেকচারে উপমা ব্যবহার করে অট্টহাসি দিতেন। ছাত্ররাও তাতে অংশ নিতো। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ অথচ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। ভিসি হওয়ার অফার পেলেও তিনি তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেছিলেন। এরশাদ জমানায় বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওতে তার সাক্ষাৎকার প্রচার হতো। তালুকদার মনিরুজ্জামান ১৯৩৮ সালের ১ জুলাই সিরাজগঞ্জের তারাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় পঞ্চম এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসিতে মেধাতালিকায় প্রথম হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে প্রথম শ্রেণি এবং মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি লাভ করেন। তিনি ১৯৬৩ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কানাডা গমন করেন ও সেখানকার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে আসেন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছিলেন। এরপর ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬ সালে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনয়ন দেয়। নানামুখী কর্ম-সাধনার পাশাপাশি তিনি রচনা করেন অনবদ্য কিছু গ্রন্থ। তিনি জীবদ্দশায় লিখেছেন কম, কিন্তু যা লিখেছেন তাই হয়ে উঠেছিলো চকচকে খাঁটি সোনা। বিশ্বময় তাই সমাদৃত তার ইংরেজি বইগুলো। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় নিরাপত্তা, রাজনীতি ও বিবিধ বিষয়ে মোট ৯টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়টি হলো— (১) The All India Muslim League (A Social Analysis 1906-1946), (২) বাংলাদেশের রাজনীতি: সংকট ও বিশ্লেষণ, (৩) Group Interests And Political Changes Studies of Pakistan And Bangladesh (৪) তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা (৫) Security of Small State in Third World (৬) The Bangladesh Revolution and its Aftermath. ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বরহাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন কোর্সের ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত পড়াতেন অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী স্যার। মাস্টার্সেও তাকে পেয়েছিলাম। মাস্টার্সে Course No. 401: Modern Political Thought এর একটি অংশ তিনি পাঠদান করতেন। অনার্সে পড়ানোর সময় প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. খালিদ বিন সাইদের ‘পলিটিক্যাল সিস্টেম ইন পাকিস্তান’, ‘পাকিস্তান: ফরমেটিভ ফেইজ’ এবং ‘'পলিটিক্স ইন পাকিস্তান’ এর মতো বেশকিছু সাড়া জাগানো বইয়ের রেফারেন্স দিতেন। কে বি সাঈদ ১৯৫১ সালে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী খালিদ বিন সাইদ ১৯২৬ সালের ২০ নভেম্বর ভারতের বেল্লারিতে জন্মগ্রহণ করেন। পরে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান এবং সেখানে নাগরিকত্ব নেন। এই প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।

বেপারী স্যার ১৯৭২-৭৩ সেশনে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ভর্তি হন। স্যার জ্ঞানে-গুণে আমাদের কাছে ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক। নিচু স্বরে কথা বলতেন এবং আমাদের ‘আপনি’ বলে সম্মোধন করতেন। স্যারের লেকচার আজও মনে পড়ে। মার্কসবাদ পড়ানোর সময় বলতেন ‘পানির মতো সহজ’। লেকচার দেওয়ার সময় তিনি ক্লাসের সামনে থেকে পেছনে চলে আসতেন। স্যার বলতেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত-আট বছর বারান্দায় হাঁটাহাটি করলে যে জ্ঞান পাবেন, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে তা পাবেন না।’ তিনি ২০১৩-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দল সমর্থিত শিক্ষক সমিতির নেতা ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিকল্প ধারা বাংলাদেশের একাংশের সভাপতি। শিক্ষানুরাগী ড. নুরুল আমিন বেপারী নিজ গ্রামে ‘ড. নুরুল আমিন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে ন্যাব (NAB) নামে পরিচিত বেপারী স্যার একজন অকৃতদার। তিনি মাদারিপুর জেলার শিবচর উপজেলার উমেদপুর গ্রামের একটি বনেদি পরিবারের সন্তান। ওনার ছোট ভাই বিএম দেলোয়ার সরকারি কলেজের প্রফেসর ছিলেন। আরেক ছোট ভাই প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী স্যারের কথা বলার চমৎকার ভঙ্গি ছিলো, যা আমাদেরকে বিমোহিত করতো।

অনার্স তৃতীয় বর্ষে ‘Public Administration in Bangladesh’ (Course No. 206) এবং মাস্টার্সে ‘African Politics’ (Course No. 406) পড়িয়েছিলেন অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মন। তিনিও আমাদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। দেখতে ছিলেন সুদর্শন। শিক্ষার্থীদের সাথে সহজে মিশতে পারতেন এবং সহযোগিতা করতেন। অসম্ভব বিনয়ী ছিলেন। বর্মন স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৬৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ভারতের রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এই বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। তিনি দুই মেয়াদে ২০২১ সাল পর্যন্ত আশা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের (এএসএইউবি) ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কিছুটা অসুস্থ। স্যারের বাড়ি গাজীপুরে।

একেএম শহীদুল্লাহ স্যার Oriental Political Thought (Course No. 212) পড়াতেন। আমাদের সহপাঠীদের প্ররোচনায় আমি এই কোর্সটি নিয়েছিলাম, যারা মাদরাসার থেকে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো। আমি মনে করেছিলাম স্কুল-কলেজের ধর্মীয় বিষয়ের মতো এই কোর্সেও বোধহয় ভালো নম্বর পাওয়া যাবে। স্যার দেখতে অনেক সুন্দর ছিলেন। গায়ের রং ছিলো ফর্সা, পান খেতেন। চুলও বেশ ছিলো। ২২তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনি এক্সপার্ট হিসেবে আমার ভাইভা বোর্ডে ছিলেন। আর এই বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন আমাদের বিভাগের আরেকজন শিক্ষক পিএসসির মেম্বার অধ্যাপক ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী। হাসানুজ্জামান স্যার ২০১৬ সালে থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলেন। যাই হোক, বিসিএস রেজাল্টের পরের ঘটনা। ঢাকার একটি ভালো মানের কলেজের নিয়োগ পরীক্ষায় শহীদুল্লাহ্ স্যারের সাথে দেখা হয়। তিনি বিসিএস দেওয়ার কথা বললে আমি বলেছিলাম ২২তম বিসিএসে আপনার বোর্ডে পড়েছিলাম। চাকরি হয়নি। কলেজটিতে আমি নিয়োগ পেলেও পরে সেখানে যোগদান করিনি। অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০০৮ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। স্যারের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার জিয়ারকান্দি। তিনি ২০২১ সালে ২৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

‘Qualitative & Quantitative Approaches to the Study of Politics’ পড়াতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বর্তমান চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। ২০২২ সালের ৩০ জুন হতে দুই বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লেকচার থিয়েটারে আমাদের ক্লাস নিতেন। তার হিলের শব্দ শুনে বুঝতে পারতাম ম্যাডাম ক্লাস নিতে আসছেন। পরিপাটি হয়ে ক্লাসে আসতেন। তার প্রমাণ তিনি চেয়ারপার্সন হয়েই ডিপার্টমেন্টকে শৈল্পিকভাবে সাজিয়েছেন। বিভাগীয় লনে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি সাবেক চেয়ারম্যানের ছবিসহ সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং নান্দনিক কারুকার্যশোভিত ওয়ালমেট দিয়ে ডিপার্টমেন্টের দেয়াল সুসজ্জিত করেছেন। স্পষ্ট ভাষায় বক্তৃতা করতেন। যা ছিল বেশ শ্রুতিমধুর। ১৯৮৪ সাল থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর আগে ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে এ বিভাগ থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী শিক্ষকতার পাশাপাশি জাতিসংঘের প্লাটফর্ম অব ডিজাস্টার ডিসপ্লেসমেন্টের অ্যাডভাইজরি গ্রুপের সদস্য এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি সংক্রান্ত জাতীয় অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ম্যাডামের বাবা সাহিত্যিক, লোকগবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলাায়। ম্যাডামের পড়ানো এই কোর্সটি অন্য কোর্সের অংশ ছিলো কি-না মনে নেই। না-কি, না বুঝে শুধু ক্লাস করতাম। আমার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের প্রবেশপত্রে এই কোর্সের নাম নেই। তাই আজ এত বছর পরে এসে সন্দেহ হচ্ছে।

আরও কিছু কোর্স ছিলো যেমন— Paper-III (A): Selected Texts: The Republic of Plato And Hobbes: Leviathan Or, Paper-II (B): Selected Texts: The Politics of Aristotle And The Social Contract: J. J. Rousseau Or, Paper-III (C): Qualitative/Quantitative Approaches to the Study of Politics, Paper-V (A): Comparative Politics in South & South East Asia Or, Paper-V (B) : Political Economy of Bangladesh, Paper-VIII: (A) Politics and Personalities in the Sub-continent. এই কোর্সগুলো সিলেবাসে থাকলেও সবগুলো কোর্স শিক্ষার্থীরা নিতো না মনে হয়। তবে Comparative Politics in South & South East Asia এবং Political Economy of Bangladesh কোর্স দুটি অনেকেই নিতো।

এবিএম আবদুল লতিফ স্যার নিতেন Comparative Politics in South & South East Asia কোর্সটি। তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো আজাদ। আজাদ এই কোর্সটি নিয়েছিল। তার কাছ থেকে স্যারের প্রশংসা শুনতাম। তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পৌর সদরের বাউফল হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষে ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে এসএম হলের ভিপি হন। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আবদুল লতিফ স্যার। ১৯৫৩ সালে সিএসপি (পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বেধে দেওয়া শর্ত মেনে চাকুরিতে তিনি যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। এরপর বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন। অবশেষে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ যোগদান করেন এবং সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান আব্দুল লতিফ। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৫ বাংলা একাডেমি তাকে ফেলোশিপ দেয়। নিউমোনিয়া, সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Political Economy of Bangladesh কোর্সটি পড়াতেন বি কে জাহাঙ্গীর স্যার। তার পুরো নাম বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। অনেকই তার এই কোর্সটিতে ভালো নম্বর পাওয়া আশায় নিয়েছিল। এই কোর্সটি আমার ছিল না। প্রথম বর্ষে তিনি আমার টিউটোরিয়াল টিচার ছিলেন। তিনি কলাভবনের বিভাগীয় অফিসের পূর্ব দিকের বড় রুমে বসতেন। এখানেই তিনি একদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। নাম, পরিচয় ও কোন ছাত্র রাজনীতিতে বিশ্বাসী তা জিজ্ঞেস করেছিলেন। এবার আসতে পারেন বলার পর আমি স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আবার কবে ক্লাস হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘আর ক্লাসের দরকার আছে বলে মনে করেন?’ আমি শুধু নীরব ছিলাম। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন। মাস্টার্সেও তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন। সম্ভবত Social Change and Political Development (Course No. 402) কোর্সের একটি অংশ তিনি পড়াতেন। তবে এতটুকু মনে আছে তিনি শিক্ষার্থীদের এলিট হিসেবে চিহ্নিত করতেন। মৌলবাদ ও মিশেল ফুকোর তত্ত্ব তিনি আলোচনা করতেন। আর পরীক্ষার খাতায় মূল বক্তব্য উপস্থাপনের পরামর্শ দিতেন। নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে স্যার একটু উদার মনের অধিকারী ছিলেন। সময়মতো ক্লাসে আসতেন। লেকচার দিতেন একটু জটিল শব্দ ব্যবহার করে শুদ্ধ ভাষারীতিতে। এ সময় আ, ও— এ ধরনের কোনো শব্দও বলতেন না। আমরা মনে করতাম তার লেকচার পিএইচডি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত। বৃহত্তর যশোর ছাত্রকল্যাণ সংসদের ম্যাগাজিন ‘কপোতাক্ষ’তে চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ওপর তার একটি লেখা ছাপানোর জন্য অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন দু'একটা ভুল আছে সংশোধন করে নিয়েন। স্যারের এক ভাই সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর ছিলেন। ওনার নাম মনে নেই। আরেক ভাই সাবেক আমলা ও মন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। স্যারের ভাতিজা প্রফেসর মুনতাসীর মামুন। অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর ১৯৩৬ সালের ৯ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার কচুয়ার গুলবাহারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ১৯৫৫ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৬ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। ১৯৭২-৭৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। প্রথিতযশা এই কবি, গবেষক, লেখক ও চিত্রসমালোচক ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০৯ সালে একুশে পদক পান। ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য। ২০২০ সালের ২৩ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে বার্ধ্যক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় বর্ষে আমার টিউটোরিয়াল টিচার ছিলেন অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন। ম্যাডামের গ্রুপে আমরা সম্ভবত ৫ ‘আলী’ ছিলাম। ইউসুফ আলী, জুলমাত আলী, ইউনুছ আলী, ইদ্রিস আলী, নওজেশ আলী। আমরা যে ‘আলী’ গোষ্ঠী তা ম্যাডাম নিজেই আবিষ্কার করেছিলেন। টিউটোরিয়াল ক্লাসে তিনি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার খবর নেন। খাবারের মান শুনে তিনি বলেছিলেন ‘হলের পানি ভালো এবং তোরা বেশি করে পানি খাবি।’ তিনি শিক্ষার্থীদের ‘তুই’ বলতেন। অধ্যাপক ড. শওকত আরা হোসেন ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এই বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০-৭২ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের অধীনে গবেষণা করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সর্বপ্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনকারী।

আরও পড়ুন

‘পেটে যত জায়গা, প্লেটে তার চেয়ে বেশি’
বায়ুদূষণের হটস্পট দক্ষিণ এশিয়া!

তৃতীয় বর্ষে টিউটোরিয়াল টিচার ছিলেন ড. হারুন-অর-রশিদ। লেকচার থিয়েটারের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ তলায় তার রুম ছিল। একদিন বা দুদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। একটি পরীক্ষাও নিয়েছিলেন। প্লেটোর ‘আদর্শ রাষ্ট্র’ সম্পর্কে লিখতে দিয়ে স্যার কোনো একটি জরুরি কাজে চলে যান। প্রশ্নের কয়েক লাইন লেখার পর আমার বলপেনের কালি শেষ হয়ে যায়। পরীক্ষা দিয়ে কী হবে— এই মনোভাব নিয়ে সেদিন আর পরীক্ষার খাতা জমা না দিয়েই চলে আসি। কিছুদিন পর মনে হলো পরীক্ষা দিলে তো কমপক্ষে ১০ নম্বরে ৫ পেতাম। নম্বরটা কমে যাবে। স্যার তখন এসএম হলের হাউজ টিউটর। একদিন বিকেলে বন্ধু ইয়ার আহমেদকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে তার হলের বাসায় হাজির হলাম। এই প্রথম কোনো ব্যাপারে কোনো স্যারের বাসায় যাওয়া। স্যারকে পেলাম। দুরুদুরু মনে বিষয়টি স্যারের কাছে উত্থাপন করলাম। সেদিন তিনি বলেছিলেন, তোমরা ছাত্র হলেও পরীক্ষা দিতে চাও না। যাও, বিষয়টি আমি দেখবোনে। তার একদিন পরেই তিনি কি কাজে বিদেশে চলে যান। বেপারী স্যার ও তিনি ক্লাসমেট ছিলেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৮৪ সালে সহকারী অধ্যাপক হন। পরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, সিন্ডিকেট সদস্য, স্যার এএফ রহমান হলের প্রভোস্ট, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের তিনবার নির্বাচিত ডিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (২০০৯-১২), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালের দুইবারের উপাচার্য (২০১৩-২০২১) ছিলেন। বন্ধুবিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। সম্প্রতি তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ১৯৫৪ সালের ২৭ অক্টোবর পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার আইরন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৮৯-৯০ সেশনের কোর্স পদ্ধতির তিন বছরের অনার্স ১৯৯২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল শুরু হয় ১৯৯৪ সালের ৫ মে। আমাদের সময়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে সেশনজট ছিলো। ক্যাম্পাসে মারামারি হলে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতো। যাই হোক, ১৯৯৪ সালের ২৯ অক্টোবর অনার্সের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়।

ফল প্রকাশের আগেই আমাদের মাস্টার্সের ক্লাস শুরু হয়ে যায়। এমএসএস (ফাইনাল) এ তিনটি আবশ্যিক কোর্স ছিল— Modern Political Thought (Course No. 401), Social Change and Political Development (Course No. 402) এবং Bangladesh Politics (Course No.403)। আর ৫টি Optional Course এর মধ্যে থেকে পছন্দমতো একটি কোর্স নিতে হতো। সেগুলো হলো— Public Policies: Bangladesh (Course No. 404), Military and politics: Third World Countries (Course No. 405), African Politics (Course No. 406), Political Ideas in the Bengali Literature (Course No. 407) এবং Problems of Governance (Course No. 408)। আমি Optional Course হিসেবে African Politics (Course No. 406) নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

Modern Political Thought (Course No. 401) পড়াতেন তিনজন শিক্ষক। প্রফেসর ড. এম নজরুল ইসলাম, প্রফেসর ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া এবং প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী। তিন গ্রুপে, না একটি কোর্সই তিনজন পড়াতেন মনে করতে পারছি না। নজরুল স্যার অসাধারণ পড়াতেন। তিনি Liberalism-এর ওপর ক্লাস নিতেন তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। একবার ডিপার্টমেন্টের পূর্বদিকে যেখানে স্যারদের কক্ষ ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আর রিপন গল্প করছিলাম। স্যারকে দেখেই সালাম দিলাম। তিনি কয়েক কদম দূরে গেলেই কি নিয়ে যেন আমরা হাসাহাসি শুরু করেছি। স্যার ঘুরেই তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমরা তো লজ্জায় পড়ে গেলাম এবং বললাম এমনিতেই হাসছি। স্যার চলে গেলেন। আমরা হাফ ছেড়ে বেঁচে গেলাম। ২০০৩ সালের ৮ জানুয়ারি কথা। আমি তখন সিটি রয়েল কলেজে ছিলাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক ড. এম নজরুল ইসলাম। তিনি তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম, বারডেম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা এমএ রশিদ এবং বিশিষ্ট কলামিস্ট খন্দকার মজহারুল করিম (২০০৩ সালের ২৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন)। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর লতিফুর রহমান। আমি সেমিনারে মূল প্রবন্ধের উপস্থাপক ছিলাম। এরপর স্যারের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। নজরুল স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৬৬ সালে এমএ করেন। তারপর ১৯৬৯-৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ফরেন প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলেন।

প্রফেসর ড. আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া Modern Political Thought (Course No. 401) এর কোন অংশ পড়াতেন তা মনে নেই। তবে ক্লাসে ডিটেকশান দিতেন। স্যারের লেখা বই আমরা অনেকেই পড়েছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (সম্মান) এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ সালে। তিনি ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০০৬ সালের ৩০ জুন থেকে ২০০৯ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষকতা জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর ব্যয় করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ২০১৪ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান। স্যারের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায় অবস্থিত। ৪০১নং কোর্সের Marxism পড়াতেন ড. নুরুল আমিন বেপারী স্যার।

৪০২নং কোর্সভুক্ত Social Change and Political Development ক্লাসও নিতেন তিনজন। অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মোস্তফা চৌধুরী এবং অধ্যাপক ড. ম আতাউর রহমান। মোস্তফা চৌধুরী স্যার বেশ কঠোর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার সামনে কেউ সেমিনার লাইব্রেরিতে গল্প করলে নিস্তার ছিল না। আর পরীক্ষার হলে নকল ধরলে তিনি সোজাসুজি বহিষ্কার করে দিতেন। আমাদের ক্লাসে তিনি S P Hantington এর ‘Political Order in Changing Societies’ গ্রন্থের রেফারেন্স দিতেন। তাতে মনে হতো তিনি Hantington এর একজন ভক্ত ছিলেন। মোহাম্মদ মোস্তফা চৌধুরী স্যার ফেনীর গুথোমা গ্রামে ১৯৪০ সালের ২৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ (অনার্স) ও এমএ শেষ করে সরকারি রাজশাহী কলেজ ও সরকারি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৬ সালে তিনি প্রফেসর হিসেবে অবসরে নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু বৃত্তি নিয়ে ১৯৭৩ সালে কানাডা যান এবং ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সপ্তম চেয়ারম্যান হিসাবে ২৫ মার্চ ১৯৯৮ দায়িত্ব লাভ করেন এবং ২০০২ সালের ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি সিভিল সার্ভিস কলেজের চেয়ারম্যান এবং Association for Protection of Human Rights এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছে ‘অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোস্তফা চৌধুরী স্বর্ণপদক’। ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কানাডার টরেন্টোতে ৭৪ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

প্রফেসর ড. ম আতাউর রহমান স্যারও ৪০২নং কোর্স টিচার ছিলেন। আমি তার ক্লাস করেছি। তার ক্লাস ভালো লাগতো। কারণ তিনি বক্তৃতা পদ্ধতিতে ক্লাস নিতেন না। তার ক্লাস ছিলো অংশগ্রহণমূলক। তিনি আমাদের কাছে মতামত নিতেন। আমরা ভুল করলে তিনি সংশোধন করে দিতেন। এ ধরনের পদ্ধতিতে পড়ানোর জন্য আমরা আগ্রহ নিয়ে তার ক্লাস করতাম। স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে থেকে বিএ (অনার্স), এমএ সম্পন্ন করে ১৯৬৯-৭০ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮৭ সালের ২ মার্চ থেকে ১৯৮৮ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৫-৮৭ পর্যন্ত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাপানিজ স্টাডিজ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা, যা পরবর্তীকালে পূর্ণাঙ্গ বিভাগে পরিণত হয়। তিনি Center for Governance Studies এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন এবং একজন গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।

Public Policies: Bangladesh (Course No. 404) এবং Political Ideas in the Bengali Literature (Course No. 407) কে পড়াতেন আমার জানা নেই। তবে Problems of Governance (Course No. 408) কোর্সের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক এম সাইফুল্লাহ ভূঁইয়া। তিনি আমাদের ভার্সিটি জীবনের একেবারে শেষ দিকে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৮ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এম সাইফুল্লাহ ভূঁইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক সাইফুল্লাহ ভূঁইয়া আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড অ্যাট কলেজ পার্ক এ সিনিয়র ফুলব্রাইট ফেলো হিসেবে শিক্ষকতা করেন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রভোস্ট ছিলেন। সাড়ে চার দশকের শিক্ষকতা জীবন শেষে ২০০৭ সালে অবসরে যান। ছোট মেয়ে আইরিন সুলতানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

মাস্টার্সে আমার টিউটোরিয়াল শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর ড. এএইচএম আমিনুর রহমান। স্যারের রুম ছিল কলাভবনের নিচতলার দক্ষিণ পূর্ব দিকে। স্যারের রুমের দক্ষিণ দিকে কয়েকটি ক্লাস রুমের পরেই ছিলো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অফিস। স্যার ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় কথা বলতেন। আমাদেরকে ১০টি অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে দিয়েছিলেন। যা ছিল কঠিন কাজ। আমি মাত্র ৬টা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছিলাম। তিনি ১৯৭৩ সালের ১১ আগস্ট প্রভাষক হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। শিক্ষকতা জীবনে প্রক্টর (০১/১০/১৯৮৯-২৮/০২/১৯৯০) এবং আন্তর্জাতিক হোস্টেলের ওয়ার্ডেন (০৬/১১/১৯৯৩-১৫/০৬/১৯৯৭) ছিলেন। তিনি ২০০৯ সালের ১৮ জুলাই ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

আমাদের সময়ে ডিপার্টমেন্টে আরও কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। অধ্যাপক ড. নাজমা চৌধুরী, প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর ড. আফতাব আহমেদ এবং প্রফেসর ড. নাদিরা পারভীন। অধ্যাপক ড. নাজমা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্কুল জীবন কেটেছে ঢাকা ও রাজশাহীতে। এসএসসিতে মেয়েদের মধ্যে অষ্টম স্থান এবং এইচএসসিতে মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিলো নবম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন নাজমা চৌধুরী। ১৯৮৪-৮৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। এসময়ে তিনি বিভাগে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন বিষয়ক নানা কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে ২০০০ সালের ৯ মার্চ উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠার হলে তিনি বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নাইরোবি ও বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক রোকেয়া চেয়ার মনোনীত হন। ২০০৮ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। তার স্বামী মাইনুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। শিক্ষাবিদ ড. নাজমা চৌধুরী ২০২১ সালের ৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

অধ্যাপক ড. আফতাব আহমেদ ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মির্জানগরে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘বীরউত্তম’, ‘বীরবিক্রম’, ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবগুলোর প্রস্তাব তিনিই প্রথম করেন। দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’র প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে বিএ (অনার্স) এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান। ২০০০ সালে ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ২০০৬ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর তিনজন বন্দুকধারী সন্ত্রাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ড. আফতাব আহমেদের বাসায় হামলা করে এবং তাকে গুলিবিদ্ধ করে। ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।

অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্যারকে অনার্সে পড়ার সময় না দেখলেও মাস্টার্সে দেখেছি। তবে কোন কোর্স পড়াতেন বা পড়িয়েছেন কিনা মনে নেই। আমাদের প্রায় ৭ বছর শিক্ষা জীবনে তিনি অধিকাংশ সময় বিদেশে কাটিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট সিনেটের সিনেট ফেলো (১৯৮৯) এবং পরে জাপান ফাউন্ডেশন ফেলো (২০০১) হিসেবে কাজ করেছেন। জাপানের ইয়োকোহামা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (২০০২) এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। ২০০৯ সালের ৩০ জুন থেকে ২০০৯ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ডক্টর কামাল আহমেদ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিষয় বিশেষজ্ঞ, প্রশ্ন-সেটার এবং পরীক্ষার পেপার মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সেন্সর বোর্ড এবং বাংলাদেশ সরকারি সমবায় সমিতির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ASB) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (IIPA) আজীবন সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ( ২০০৭) কর্তৃক প্রকাশিত ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন। তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান একজন শিক্ষক ছিলেন।

আমাদের সময়ে অধ্যাপক ড. খন্দকার নাদিরা পারভীন ম্যাডাম ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১৯৭৯-৮০ অনার্স ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি আশির দশকের একজন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী। এই জগতে তিনি নাদিরা আশরাফ মহুয়া নামে সমধিক পরিচিত। তার বেশ কয়েকটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল। ম্যাডামের স্বামী প্রফেসর ডা. আশরাফ হোসেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। আমি তাকে কোর্স শিক্ষক হিসেবে পাইনি।

মাস্টার্সে আমরা ‘হৃদয়ে হৃদ্যতায় আমরা’ নামে একটি স্মৃতি অ্যালবাম বের করেছিলাম। সেখানে আমাদের শিক্ষকদের একটি তালিকা ছিল। সেই তালিকায় ডক্টর সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম স্যারের নাম ছিল। যদিও অন্য স্যারদের ছবি থাকলেও তার ছবি ছাপা সম্ভব হয়নি। আমরা কখনোই তাকে ডিপার্টমেন্টে দেখিনি। সম্ভবত তখন তিনি কানাডায় ছিলেন এবং বর্তমানে সেখানকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাইদের কাছ থেকে জেনেছি তিনি একজন বিজ্ঞ শিক্ষক ছিলেন। খুব সহজ, সাবলীল ভাষায় লেকচার দিতেন।

আমাদের সিনিয়র ব্যাচের ভাইদের মধ্যে তখন ৩ জন প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। তারা হলেন— ফরিদ উদ্দীন, জাহিদ হাসান চৌধুরী মন্টু এবং এমরান হোসেন। তারা আমাদের কোনো ক্লাস নেননি। তাদেরকে মাস্টার্সের পরীক্ষার হলে শুধু ডিউটি করতে দেখেছি। মন্টু ভাই ভালো ডিবেটর ছিলেন। এখন যুক্তরাজ্যে থাকেন। ফরিদ ভাই এখন প্রফেসর।

আমরা ছিলাম ১৯৯২-৯৩ সেশনের এমএসএস শেষ পর্বের শিক্ষার্থী। বার্ষিক কোর্স পদ্ধতিতে ১৯৯৩ সালের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালের ২৪ অক্টোবর, যা চলে কয়েকমাস ধরে। আমরা ২৯৪ জন এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আমাদের পূর্ববর্তী ব্যাচের ছিল। পরীক্ষা শুরু থেকে ৯ মাস ২৩ দিন পরে অর্থ্যৎ ১৯৯৬ সালের ১৭ আগস্ট আমাদের মাস্টার্সের ফল প্রকাশিত। আর মধ্যে দিয়েই ৪ বছরের পরিবর্তে ৭ বছর ২ মাস ২ দিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর প্রায় তিন যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। এই সময়ে নদীর জল অনেক গড়িয়েছে। আমরা যুবক থেকে মধ্য বয়সে উপনীত হয়েছি। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র তিনজন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আছেন। অনেকেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা যেসব চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন কিংবা আমাদের স্বপ্ন দেখাতেন, তা আমরা কতটুকু ধারণ করেছি তা জানি না। তবে পরম পূজনীয় শিক্ষকদের কথাগুলো অনেকেই মনে রেখেছি।

বি এম ইউসুফ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং সাধারণ সম্পাদক, ডুপসা-এমএসএস ‘৯৩