images

জাতীয়

রোজায় বাড়বে সংকট!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন

১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৭:২৯ এএম

মাত্র এক মাস পরই পবিত্র মাহে রমজান। ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী আগামী ২৪ মার্চ শুরু হচ্ছে সিয়াম সাধনার এই মাস। রমজানকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে। অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে মানুষ একটু বেশি খরচ করার চেষ্টা করে। সারাদিন সিয়াম সাধনার পর ইফতার ও সাহরিতে একটু ভালো খাবার বাংলাদেশের মানুষের চিরাচরিত ঐতিহ্য। মাহে রমজান শেষে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ঘিরেও থাকে অনেক আয়োজন।

কিন্তু এবার এমন এক সময় মাহে রমজানের আগমন যখন নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বাড়তি বিলের বোঝা। এছাড়া রমজানে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবমিলে সাধারণ মানুষের জন্য এবারের রমজানে সঙ্কট বাড়বে বলেই মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

দফায় দফায় বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির সঙ্গে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে ভোক্তার ওপর। জ্বালানির বাড়তি দামের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি, ডালের দাম। চাল, আটা, সয়াবিন তেল, শিশুখাদ্যসহ এমন কোনো পণ্য নেই যেটার দাম বাড়েনি। এক বছরে চালের দাম ৪০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আটার দাম প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৮৫ টাকা হয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় যাতায়াত ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ এখন ব্যয় হচ্ছে খাবারের পেছনে।

নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এতটাই যে এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও ব্যাগ ভরছে না ক্রেতার। এক যুগের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। আড়াইশ টাকার গরুর মাংস এখন কিনতে হচ্ছে কমপক্ষে ৭০০ টাকায়। ১০০-১১০ টাকার ব্রয়লার মুরগির দাম ২শ টাকা। ১০০-১২০ টাকার মাছ এখন কিনতে হচ্ছে দুই-আড়াইশ টাকায়। ভরা মৌসুমেও সবজির দাম চড়া। এক হাজার টাকার বাজার করলেও ব্যাগ ভরছে না ক্রেতার।

আর পড়ুন: ‘সিন্ডিকেটের’ কাছে অসহায় ভোক্তা

এদিকে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের অধিকাংশ এলাকায় তীব্র গ্যাস সঙ্কট। শিল্প-কারখানা ও আবাসিক- উভয়ক্ষেত্রেই এই সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। বেশিরভাগ এলাকায় দিনের বেলায় জ্বলে না চুলা। রাতে চুলা জ্বললেও গ্যাসের চাপ কম থাকে। পূর্ণমাত্রায় গ্যাস আসে মধ্যরাতে, ভোর হওয়ার আগেই চলে যায়। তাই এসব এলাকার বাসিন্দাদের রান্না করতে হচ্ছে গভীর রাতে। এতে বদলে যাচ্ছে কোটি মানুষের দৈনন্দিন রুটিন।

gas

রাজধানীর মালিবাগ, বাসাবো, বনশ্রী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, গাবতলী এলাকায় গ্যাসের এই সঙ্কট অনেকটা নিয়মিত সমস্যা। সম্প্রতি মগবাজার, ইস্কাটনসহ অনেক অভিজাত এলাকাতেও গ্যাসের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সবমিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেকেই লাইনের গ্যাসের পাশাপাশি ব্যবহার করছেন এলপিজি সিলিন্ডার, ইলেকট্রিক চুলা। এতে দ্বিগুণেরও বেশি হচ্ছে গ্যাসের খরচ।

আবার রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জায়গায় সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার। সাধারণত বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজে ১২ কেজি সিলিন্ডার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক ধাক্কায় ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যা এতদিন ১ হাজার ২৩২ টাকা ছিল। দাম বাড়ানোর পরও সরকার নির্ধারিত দামে এলপিজি সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক জায়গায় এলপিজির কৃত্রিম সঙ্কটের খবরও পাওয়া গেছে।

শুধু গ্যাস নয়, সঙ্কট রয়েছে বিদ্যুৎ নিয়েও। দফায় দফা দাম বাড়নোর পরও রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আর পড়ুন: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

এদিকে ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশ থেকে রমজানের ছয়টি নিত্যপণ্য (ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজ) আমদানি ব্যহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। যদিও রোজার পণ্য আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ীরাও রমজানের পণ্য আমদানির জন্য আলাদাভাবে ডলার মজুত রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে যে রমজান মাসটা একটু ভালোভাবে কাটানো। এই মাসে একটু খরচ বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে এবারের রমজান মাসটা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের বেশ কষ্টে যেতে পারে। তার ওপর বিদ্যুতের বাড়তি দাম, গ্যাস সঙ্কট, এলপিজির দাম সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থা।

তিনি আরও বলেন, আবার সামনে গরম আসছে। এবার শীত শেষ হতে না হতেই লোডশেডিং দেখা দিয়েছে। তাতে রমজানে তো লোডশেডিং আরও বেশি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। যদিও সরকার থেকে বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলএনজি আমদানি করা হবে। এখন দেখার বিষয় সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন কার হয়।

আর পড়ুন: দাম বাড়লেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিয়ে শঙ্কা

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আসন্ন রমজান ঘিরে কোনো সঙ্কট নেই। এবার রমজানে পণ্যের দাম নাগালের বাইরে যাবে না। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। আসন্ন রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

রোজার শুরুতে একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ভোক্তারা একসঙ্গে পুরো রমজানের পণ্য কিনলে বাজারে এর একটা প্রভাব পড়ে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তখন সুবিধা নিয়ে থাকে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

টিএই/জেএম