শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন দাম ঘোষণা করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

এমন এক সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অনেকটা দিশেহারা সাধারণ মানুষ। গ্যাসের এই দামবৃদ্ধি আরও প্রভাব ফেলবে নিত্যপণ্যের ওপর। ফলে আরও চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অযৌক্তিক ব্যয় ও মুনাফা সংযোজন না কমিয়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার, যা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।


বিজ্ঞাপন


নতুন ঘোষণায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পাঁচ টাকা দুই পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ টাকা। আর সার কারখানার জন্য বাড়ানো হয়নি, সেটি আগের মতো অর্থাৎ ১৬ টাকাই রয়েছে।

শিল্প-কারখানার ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের (হোটেল, রেস্তোরাঁ) ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম ২৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ টাকা।

Gasতবে সিএনজি স্টেশন ও আবাসিকে গ্যাসের দাম আগের মতোই আছে। সিএনপি স্টেশনে প্রতি ঘনমিটার ৪৩ টাকাই থাকছে। আর আবাসিকে দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ১০৮০ টাকা, এক চুলার মাসিক বিল ৯৯০ টাকাই রয়েছে। আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। যেহেতু উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সে কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের মনে হয়েছে সরকারের বিকল্প সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ ছিল। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সার্বিকভাবে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া হতে পারে। প্রথমতো, আইএমএফের সঙ্গে সরকারের আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের আলোকে ভর্তুকি সমন্বয়ের অংশ হিসেবে এই মূল্যবৃদ্ধি। ফলে পেট্রোবাংলাকে হয়তো কম ভর্তুকি দিতে হবে। তাতে সরকারের কিছুটা সাশ্রয় হবে। তারপরও হয়তো ভর্তুকি দিতে হবে। তবে যেহেতু আবাসিক গ্রাহকদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে, ফলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাবটি হয়তো তুলনামূলকভাবে কম হবে।

Gasতিনি আরও বলেন, যে উদ্দেশ্যে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের যে প্রত্যাশা, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ। আমাদের মনে হয়, মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে গ্যাস সরবরাহে শিগগিরই বড় কোনো উন্নতি হবে না। কারণ গ্যাস সরবরাহের জন্য সরকারকে এলএনজি আমদানি করতে হবে এবং তার জন্য বাড়তি ডলার দরকার। কিন্তু ডলার সংগ্রহ করার সুযোগ কম। ফলে সরকার যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আশা করছে সেটা হয়তো নাও হতে পারে। বিশেষ করে শীতকাল চলে গেলে নতুন করে আবার হয়তো গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেবে। বরং উচিত ছিল অভ্যন্তরীণভাবে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে নতুন নতুন কুপ খনন করা। অন্যদিকে আরেকটি বিষয় ঘটবে- শিল্প খাত বিশেষ করে গ্যাসভিত্তিক যেসব শিল্প খাত রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে ইস্পাত কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, টেক্টাইল মিল, সিরামিক এবং গ্লাস ফ্যক্টরিগুলোতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। যার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।

এদিকে গ্যাসের দাম নির্ধারণের পদ্ধতি মোটেই সঠিক নয় বলে দাবি করেছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা চাই স্বচ্ছ ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় এনার্জির মূল্য নির্ধারণ হবে। সেজন্য আমরা প্রেফার করি বিইআরসির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ। মূল্য বেশি বা কম- এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কি প্রক্রিয়ায় মূল্য নির্ধারণ হলো সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয় তাহলে কোথাও অপচয় আছে কি না, কোথাও সাশ্রয় করার সুযোগ আছে কি না, এগুলো আমরা জানতে পারি। এটি ভোক্তাদের একটা অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া। কিন্তু সরকার যেভাবে হুকুম দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করল এতে অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি সবকিছুই কার্পেটের নিচে চাপা পড়ে যাবে।

Gasবুধবার গ্যাসের দামবৃদ্ধির পর বৃহস্পতিবারই নতুন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্যাব সভাপতি। তিনি বলেন, গৃহাস্থলীতে তো মূল্যবৃদ্ধি করে নাই। মূল্যবৃদ্ধি করেছে শিল্প ও বিদ্যুতের। ফলে আমাদের আশঙ্কা, কয়েকদিন পর আবার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করবে এবং এই বাড়তি বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে। আর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব যদি পণ্যমূল্যের ওপর পড়ে এবং তা যদি ভোক্তা বা ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভোক্তার নাভিশ্বাস পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে যাবে। মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, গ্যাসের ক্ষেত্রে যে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় এবং মুনাফা সংযোজন হয়েছে তা সমন্বয় করলে ভর্তুকি ও মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হয় না। তা না করে ভর্তুকি প্রত্যাহারের নামে অযৌক্তিক ব্যয় ও মুনাফা সমন্বয় আড়াল করা হচ্ছে। কেন অযৌক্তিক ব্যয়, দুর্নীতিজনিত ব্যয় জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে? আমরা এর প্রতিকার চাই। সত্যিকার অর্থে আমরা সরকারের সক্ষমতার অভাব দেখছি। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

তিনি বলেন, গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধিতে বিদ্যুতের ওপর আবার প্রভাব পড়বে। আবার বিদ্যুতের দাম বাড়বে। এখন জনগণকে আরও বেশি বেশি না খেয়ে থাকার অভ্যাস করতে হবে। তাছাড়া কোনো উপায় নাই।

Gasগ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্প পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন ঢাকা মেইলকে বলেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা প্রাইসে টিকতে পারব না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাইস না বাড়লে আমরা পোষাবো কিভাবে?

এদিকে বিদ্যুতের পর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সমাজের নেতারা। এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, যাদের বড় বড় শিল্প-কারখানা আছে তারা না হয় পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প যাদের তারা কি করবে? তাদের তো পথে বসা ছাড়া উপায় নাই। আবার হোটেল-রেস্টুরেন্টেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন রেস্টেুরেন্টে খাবারের দাম আরও বেড়ে যাবে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে মানুষগুলো বাইরে থেকে আসে তাদের তো হোটেলেই খাওয়া লাগে।

তিনি বলেন, আরেকটা জিনিস খেয়াল করেন, সিএনজির দাম কিন্তু বাড়ানো হয় নাই। কারণ সিএনজি তো এখন ধনী লোকেরাই বেশি ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষ বাসে চলে, বাসে তো আর এখন সিএনজি ব্যবহার হয় না। ডিজেলেই চলে। কাজেই ধনীদের ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়ছে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরপরই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর পড়বে। এমনিতেই তো জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ নাজেহাল।

টিএই/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর