images

জাতীয়

চা বাগানে সুনশান নীরবতা, বিড়ম্বনায় পর্যটকরা

ওয়াজেদ হীরা

২১ আগস্ট ২০২২, ০৪:৪২ পিএম

Failed to load the video

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ক্যামেলিয়া লেক। চারপাশে চা বাগান। পুরো বাগানে কোনো মানুষ নেই। অথচ এই সময়ে প্রতিটি বাগানেই শ্রমিকদের ভিড় থাকে। টানা ধর্মঘটে চা শ্রমিকরা কাজে যাননি, নেই মালিকপক্ষেরও লোকজনও। এতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা পড়েছেন বিড়ম্বনায়। জনমানবশূন্য বাগানে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঢুকছেন না তারা। আবার সৌন্দর্যও ঠিকমতো উপভোগ করতে পারছেন না। প্রতিটি চায়ের বাগানে ভুতুড়ে পরিবেশ। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার চা পাতা।

গত এক সপ্তাহ ধরে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করছেন চা শ্রমিকরা। এতে চা বাগানগুলোতে বিরাজ করছে শুনসান নীরবতা। যদিও আন্দোলনের অষ্টম দিনে শনিবার (২০ আগস্ট) বিকেলে শ্রম অধিদফতরের সঙ্গে বৈঠকে কাজে ফিরবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। এসময় সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৫ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেওয়া হলে তা মেনেও নেন। কিন্তু আবার নতুন করে বেঁকে বসেছেন শ্রমিকরা। ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি না দিলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

রোববার (২১ আগস্ট) বেলা ১১টা থেকে জেলার লংলা ভ‍্যালির রাজনগর উপজেলার ইটা চা বাগানের শ্রমিকরা স্বল্প পরিসরে বিক্ষোভ সমাবেশও করেছেন। এদিন দৈনিক মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে হবিগঞ্জে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন চা-শ্রমিকরা। রোববার বেলা ১১টা থেকে হবিগঞ্জের ২৩টি চা-বাগানের শ্রমিকরা মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুরে মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক জড়ো হন। তারা দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, ‘চা শ্রমিকদের আন্দোলন চলমান থাকবে।'

আরও পড়ুন: চা শ্রমিক: বিভীষিকার কালো গহ্বরে বন্দি যাদের জীবন

নতুন করে আন্দোলনের বিষয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘আমি ওই বৈঠকে যা বলেছি তা প্রত্যাহার করে নিলাম। শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে অনড়।’

tea3

এদিকে, গত তিন দিন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, চা বাগান একেবারে ফাঁকা। গত শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনে যারা ঘুরতে গিয়েছেন তাদের অনেকের অন্যতম আগ্রহ মাধবপুর লেক এবং লেকের চারপাশে ঘেরা চা বাগান। কমলগঞ্জ উপজেলায় মাধবপুর ইউনিয়ন অবস্থিত। দর্শনীয় মাধবপুর লেক বয়ে গিয়েছে ছোট পাহাড় ও টিলার মধ্য দিয়ে। তাই পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানও বটে। তবে চা শ্রমিকরা গত শুক্রবার গেটের মুখে অবস্থান করায় পর্যটকদের ভেতরেই যেতে দেননি।

ঢাকা থেকে আসা সুমন ও তার বন্ধুরা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে এলে কিছু কমন জায়গায় বেশি মানুষ ঘোরাঘুরি করে- লাউয়াছড়া, কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক, বাইক্কা বিল ইত্যাদি। তবে আমরাসহ অনেককেই দেখেছি, শ্রমিকরা ভেতরে যেতে দেয়নি।’

আরেক পর্যটক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গাড়ি মাধবপুর যেতে না দেওয়ায় আমরা অন্যদিকে চলে যাই।’

এদিকে জানা গেছে, শ্রমিকদের এই আন্দোলনের কারণে ঘুরতে আসা পর্যটকরাও চা বাগান ঘুরে স্বস্তি পাচ্ছেন না। ফাঁকা চা বাগানের ভেতরে যেতে বা ঘুরতে কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে তাদের মধ্যে। দলবদ্ধ পর্যটন না থাকলে কেউ বাগানের ভেতরে যাচ্ছন না। বাইরে থেকে বা রাস্তা থেকে দেখে নিচ্ছেন। সেখানেই ছবি উঠাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: সেই চা শ্রমিক মাকে ফ্রিজ-স্মার্ট টিভি দিলেন গোলাম রাব্বানী

নূরজাহান চা বাগান, কালিঘাট রোডের চা বাগান, রামনগর এলাকায় ফিনলে চা বাগান, সাতগাঁও টি স্টেট, ফুলবাড়ি ট্রি স্ট্রেট এলাকার চা বাগান ঘুরে জনমানব শূন্য দেখা যায়। কিছু কিছু চা বাগানের সামনে বড় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি উঠাতে দেখা যায় পর্যটকদের।

সাতগাঁও চা বাগান এলাকায় কথা হয় সাজ্জাদুর রহমানের সাথে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, তিন দিনের সরকারি ছুটি পাওয়াতে পরিবারসহ ঘুরতে এসেছি। এখন যে বাগানেই যাই মানুষ নেই। একটা ভয় কাজ করছে। চা বাগানে সাপ থাকে শুনেছি। আবার মানুষ না থাকায় বাগানে ঢুকলে যদি কেউ কিছু বলে বা কেউ হঠাৎ হামলা করে সেই ভয়ও আছে। তাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের দেখিয়েছি।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে কথা হয় আলতাব হোসেনের সাথে। সরকারি এই কর্মকর্তাও পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সবই ঘুরে দেখেছি। এখানে চা বাগান বেশি, তবে আমাদের সাথে যারা ছিল কেউ বাগানের ভেতরে যায়নি। মানুষ না থাকলে সেখানে যেতে কেমন একটা ভীতি কাজ করে। চা বাগান ছাড়া সব জায়গায় ঘুরেছি।’

লাউয়াছড়ায় সুবল নামে একজন বলেন, চা শ্রমিকদের ধর্মঘটে সব বাগান খালি। এসময়তো প্রচুর শ্রমিক চা পাতা উঠায়। তবে সবকিছু শিগগির ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।

কমলগঞ্জের শমশেরনগরে ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমশেরনগর চা-বাগানে দৃষ্টিনন্দন লেক ক্যামেলিয়া। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ এই লেক এবং চা বাগান দেখেত ভিড় করে। সেখানে গিয়ে রাস্তায় তিনজন পর্যটক পাওয়া যায়। তবে ২০০ মিটার হাঁটলেই লেকের দেখা মিললেও তারা ভেতরে যাচ্ছেন না। পরে বাকি আরও চার পর্যটক যুক্ত হলে ভেতরে প্রবেশ করে লেক দেখে ছবি উঠিয়ে ফেরেন তারা।

চা গাছের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার কাজে ব্যস্ত থাকা নারী শ্রমিকদের সাথেও অনেকেই শখের বশে ছবি উঠিয়ে থাকেন পর্যটকরা। নেন তাদের সুখ-দুখের খবর। কিন্তু ধর্মঘটে সবই যেন পাল্টে গেছে। শ্রমিকরা বাগানে না থাকায় কথাও হচ্ছে না চা শ্রমিকদের সাথে। ছবি তোলার শখও পূরণ হচ্ছে না অনেকের।

tea2

শ্রীমঙ্গল শহরে পর্যটকদের নিয়ে বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে দেখান গাড়ি চালক জসিম উদ্দিন। ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাধপুর বা ক্যামেলিয়া লেকে নিয়ে গেলে টুরিস্টদের দিনের অর্ধেক শেষ হয়ে যেতো। আর এখন যারা আসছেন তাড়াতাড়ি কয়েকটি ছবি উঠিয়েই ১০/১৫ মিনিট পর কয় মামা অন্য জায়গায় চলেন। বাগানে কেউ নাই, শ্রমিক থাকলেতো পাতা উঠানো দেখে, বেশি বেশি ছবি উঠায়। এখন ভয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে।’

আরও পড়ুন: মজুরি বৈষম্যের শিকার শান্তি-রেহেনার মতো হাজারো চা-পাথর শ্রমিক

চা শ্রমিক অনিতা বুনার্জী, কুন্তি কুমার, যমুনা বুনার্জী, শ্যামলী বীনসহ নারী চা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে খেয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর। তারা এখনও জানেন না কবে আবার যাবেন পাতা তুলতে।

এদিকে, সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৬৮ চা বাগানে থেকে দৈনিক কয়েক কোটি টাকারও বেশি মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ধর্মঘটের মধ্যেই শ্রীমঙ্গলের চারটি চা বাগানের পক্ষ থেকে কাঁচা চা পাতা নষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। ১৭ আগস্ট শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট, আমরাইল ছড়া, ডিনস্টন ও বালিশিরা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে থানায় পৃথক জিডি করা হয়।

চা সংশ্লিষ্টদের মতে, চায়ের মৌসুম শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে আর শেষ হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে। চা উৎপাদনের পিক সিজন হচ্ছে জুন, জুলাই ও আগস্ট-এই তিন মাস। এই পিক সিজনে প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্রভেদে পাঁচ হাজার থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। এখন সেটি অনেকটাই থমকে গেছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, দেশে মোট ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান আছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৩৫টি।

ডব্লিউএইচ/জেবি