images

জাতীয়

সরকার বদলের পর ব্যাটারিচালিত রিকশায় ‘মোটা অংকের বিনিয়োগ’

কাজী রফিক

২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪২ পিএম

images

🔹 পেশা বদলে রিকশা চালাচ্ছেন অনেকে

🔹 ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ সুযোগ নিতে চায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকরা

🔹 চালকদের ‘কলকাঠি’ নাড়ছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা

🔹 অটোরিকশা টিকিয়ে রাখতে চান মাদক কারকারি-ছিনতাইকারীরাও

🔹 ব্যাটারিচালিত রিকশায় নিজেদের আড়াল করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ জানায় রিকশা চালকরা। সড়কে নেমে আন্দোলন করতে থাকেন তারা। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত বদল করে এসব যান চালানোর অনুমতি দেয় বিগত সরকার।

ক্ষমতার পালাবদলে রাজধানীজুড়ে হঠাৎ এসব রিকশার দাপট বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ট্রাফিক ব্যবস্থার ‍দুর্বলতার সুযোগে সব সড়কে বেড়ে যায় এই যান। বেপরোয়াভাবে চালানোয় এসব রিকশার দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এমন অবস্থায় হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা বদ্ধের আদেশ দিলে সড়কে নামেন চালকরা। হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও পরে আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থায় আপাতত ঢাকার রাস্তায় চলার অনুমতি পেয়ে যায় ব্যাটারিচালিত রিকশা।

লাগামহীনভাবে ব্যাটারিচালিত এসব অবৈধ রিকশা তৈরি হওয়ায় বর্তমানে সারাদেশে কত সংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে, তার সংখ্যা অজানা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে যে পরিমাণ ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার সড়কে চলত, গত সাড়ে তিন মাসে সেই সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেড়েছে। কেবল রাজধানীর মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকাতেই ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা লক্ষাধিক। কয়েক লাখের মতো অবৈধ এসব যান দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে উত্তরখান-দক্ষিণখান, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ এলাকায়। এই বাহন হঠাৎ এতটা বেড়েছে কীভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন

ছিনতাইয়ে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা!

বর্তমানে যারা অটোরিকশা চালাচ্ছেন বাড়তি আয়ের জন্য তাদের অনেকেই জুলাই বিপ্লবের পর পেশা বদল করেছেন। তাদের কেউ নিজের টাকা এই যান কিনে চালাচ্ছেন। আবার অনেকে রিকশা বানিয়ে তা ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। এতে দৈনিক ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা হারে ভাড়া পান তিনি। যারা ভাড়ায় খাটাচ্ছেন তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের নেতা বলে জানা গেছে।

কয়েকজন রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সংসারের ব্যয় মেটাতে অনেকে পেশা পরিবর্তন করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাচ্ছেন। আদাবর এলাকায় মো. বাশার নামে এক অটোরিকশা চালক ঢাকা মেইলকে জানান, ‘আগে প্রাইভেট গাড়ি চালাইতাম। এখন ওইটা ছাইড়া আড়াই মাস আগে নিজে রিকশা কিনছি। এজন্য ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে আমার।’

Rikshw2_ভালো আয়ের আশায় দেড় মাস আগে রিকশা কেনেন ৩৩ বছর বয়সী রাসেল। মোহাম্মদপুর কাটাসুর পুলপাড় এলাকার এই বাসিন্দার দাবি, ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে এখন তিনি দেড় লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন।

বর্তমানে বিক্রি হওয়া একেকটি ব্যাটারিচালিত রিকশার দাম ৭০ থেকে ৮৬ হাজার টাকার মধ্যে। দেড় লাখ টাকা ঋণ কীভাবে হলো? - এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, 'আগেরও কিছু দেনা আছি। সব মিলাইয়া দেড় লাখ আরকি!'

আরও পড়ুন

ব্যাটারিচালিত রিকশা রুখতে অসহায় ট্রাফিক পুলিশ!

নামপরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার একজন বাসিন্দা ঢাকা মেইলকে বলেন, 'এই এলাকায় এমন বহু লোক আছে, যারা নিজেরা কিছুই করে না। সারাদিন চায়ের দোকানে বইসা ক্রিকেট জুয়া খেলে। তাগো আবার রিকশা আছে। ব্যাটারির রিকশা। সেগুলো ভাড়া দেওয়া। এখন দেখি তারাও আন্দোলন করে।'

মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন কবির ও ভাঙারি বাবু। তাদের রয়েছে বিশাল রিকশার গ্যারেজ। সূত্র মতে, তাদের গ্যারেজেই আছে ৬০টির বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা। হাইকোর্টের রায়ের পর যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে কবির ও ভাঙারি বাবুরাও হাওয়া দিয়েছিল বলে জানা গেছে।

একই তথ্য মিলেছে রাজধানীর গাবতলীর হাট্টপট্টি এলাকাতেও। সিটি করপোরেশনের অধিগ্রহণ করা জায়গা ভরাট করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। যেগুলোর অনেক স্থানে আছে ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ। এর নেপথ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। 

‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’র সুযোগ নিতে চায় চালকরা

রাজধানীর ট্রাফিক পয়েন্টগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার উপস্থিতি চায় না ট্রাফিক বিভাগ। তবে পুলিশের সে সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। তারা ভিআইপি সড়ক বাদে অন্য সব সড়কে বাধাহীনভাবে চলতে চায়।

Rikshow

কয়েকদিনের আন্দোলনে ব্যাটারিচালিত রিকশা টিকিয়ে রাখার পেছনে একটি যুক্তিই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে ‘কয়েক লাখ মানুষ ব্যাটারির রিকশা চালায়’, ‘সরকার এসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুক।’

জানা গেছে, ভারতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এই রিকশা চালকদের আন্দোলনের পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ছেন। সেখান থেকেই ১০ নভেম্বর গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগ অনুসারীদের নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তিনি। একইভাবে রিকশা চালকদের আন্দোলনেও নিজেদের লোক ঢুকিয়েছেন। এতে রিকশা চালকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সেই সুযোগই এখন নিতে চায় নৌকার অনুসারী ও রিকশাচালকরা। 

অটোরিকশা টিকিয়ে রাখতে চান মাদক কারকারি-ছিনতাইকারীরাও

ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার করে ছিনতাই নতুন কিছু না। মোটরসাইকেল যোগে ছিনতাই করলে, ওই মোটরসাইকেলের নাম্বার থেকে অপরাধীকে শনাক্ত করার সুযোগ থাকে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশার মাধ্যমে ছিনতাই করলে রিকশা শনাক্তের সুযোগ নেই। সেই সুযোগ নিতে দেখা যায় ছিনতাইকারীদের।

আরও পড়ুন

প্রধান সড়কেও ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট, দেখার কেউ নেই!

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, গাবতলী, বিরুলিয়া, তুরাগ এলাকায় এ ধরণের ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়মিত। স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, ব্যাটারিচালিত রিকশায় চালক ও যাত্রীবেশে থাকেন ছিনতাইকারীরা। তারা রিকশাযোগে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে থাকেন। কাউকে একা পেলেই রিকশা থামিয়ে অস্ত্রের মুখে সব কিছু লুটে নেন এবং ব্যাটারিচালিত রিকশাযোগে দ্রুত পালিয়ে যান। ব্যাটারিচালিত রিকশা টিকিয়ে রাখতে সাম্প্রতিক আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিনতাইকারীও ছিলেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

হঠাৎ অটোরিকশা বাড়ার কারণ

কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত সাড়ে তিন মাসে রায়েরবাজার, কামরাঙ্গীরচর, বউ বাজার এলাকা থেকে বহু ব্যাটারিচালিত রিকশা বিক্রি হয়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এই রিকশার দামও অনেকটা বেড়েছে। প্রায় লাখ টাকা বিনিয়োগ করে, রিকশা নিয়ে এখন তারা নেমেছেন ঢাকার রাস্তায়।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত যেসব রিকশা বিক্রি হচ্ছে তার অনেক কিনছেন দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ৫ আগস্টের পর এলাকা ছাড়া হওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এলাকায় ফিরতে না পেরে ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছেন। যারা বেশি বিত্তশালী নেতা তারা রিকশা কিনে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। অন্যরা রিকশা কিনে নিজেই চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

দ্রুতগতিতে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা

নামপরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বরগুনার বামনা উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকা মেইলকে বলেন, 'ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর তো যারা ছাত্রলীগ করতো, তারা কেউ এলাকায় ঢুকতে পারে নাই। ঢাকায় কেউ কারও খোঁজখবর ওইভাবে রাখে না। গ্রামে সবাই সবাইকে চেনে। তাই যারা আওয়ামী লীগ করতো, তারা কেউ এলাকায় ফিরতে পারে নাই। এখন তাদের বেশিরভাগই অটোরিকশা চালায়। বাড্ডা, মোহাম্মদপুর আর মিরপুরে বেশি। আবার অনেকে রিকশা কিনে ভাড়া দিয়ে চলছে।'

এদিকে ব্যাটারিচালিত রিকশার চাপ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে রাজধানীর সড়কেও। সড়কগুলোতে বেড়েছে যানজট। এসব অবৈধ যানের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। অনেক চেষ্টা করেও এসব রিকশার অবাধ বিচরণ ঠেকাতে পারছে না ট্রাফিক পুলিশ।

কারই/এমআর