কাজী রফিক
১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৪ এএম
মন চাইলেই বাসার জানালা দিয়ে খালে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। যার ভেতরে ঘরের ময়লা-আবর্জনা। আবার চায়ের দোকানের ময়লার ঠিকানাও এই খাল। চিত্রটি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে খালটিকে। অন্যদিকে খাল দখলের মহোৎসব তো চলছেই। খালে ময়লা ফেলা কিংবা দখল ঠেকানোর দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের। মাঝে মাঝে খাল পরিষ্কার করেই দায়িত্ব সারছে সংস্থাটি। জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে খাল দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব কার?
রামচন্দ্রপুর খালের দৈর্ঘ্য দুই হাজার ৯৪০ মিটার। কিন্তু বর্তমানে আছে দুই হাজার ১৩১ মিটার। বাকিটা দখল হয়ে গেছে। এছাড়া খালের দুই পাড়েও দখলের চিত্র চোখে পড়ে। খালের ওপর গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, অস্থায়ী স্থাপনা। এমনকি নামজাদা প্রতিষ্ঠানগুলোও খাল দখলে পিছপা হচ্ছে না।
সরেজমিনে রামচন্দ্রপুর খাল ঘুরে দেখা যায়, খালের নবোদয় হাউজিং এলাকার লোহার গেইটের বিপরীতে মাটি ফেলে দখল করা হয়েছে। টিনের প্রাচীর তৈরি করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে রিকশার গ্যারেজ।
স্থানীয় বাসিন্দা আজহারুল ইসলাম ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘খালের জায়গায় জায়গায় দখল। খালের আশপাশের বাড়ির লোকজন সব ময়লা খালেই ফেলে। একদিন টানা এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি উঠে যায়। খালের মধ্যে তো আসলে সব ময়লা, পানি ধরার জায়গা তো নাই।’
খাল দখলের নজির দেখা গেছে হাউজিং এলাকায়। মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৫নং সড়কের পশ্চিম দিকে খালের প্রস্থ প্রায় ছয় ফুট। সবশেষ সীমানা নির্ধারণ অনুযায়ী, এই জায়গায় খালের প্রস্থ থাকার কথা ৩০ ফুটের বেশি। বাকি জায়গায় গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। বিষয়টি সবার চোখের সামনে ঘটলেও সংশ্লিষ্টরা যেন নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করছেন।
কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে গেলেই মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৬, ৭ ও ৮নং সড়ক। এখানেও খাল বেশ ছোট হয়ে এসেছে। দুই পাড়ে গড়ে তোলা স্থাপনার চাপে, খালে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা বেশ অপ্রস্তুল।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালের পাড়ে যেসব বাড়ি মালিক বাড়ি করেছেন, তারা নিজের জমির বাইরে গিয়ে, তিন থেকে চার ফুট পর্যন্ত খাল দখল করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা উঠলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ‘ম্যানেজ’ করে ভবন রক্ষা করেছেন।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের খালের উপরেই বাড়ি। এটা সবাই জানে। কিন্তু কেউ ভাঙে না। বাড়িওয়ালারা নেতাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলে। বৃষ্টি হলে খালে পানি ধরার জায়গা থাকে না। তখন পানি রাস্তা দিয়ে যায়। খালটাকে সবাই নিজের সম্পত্তি মনে করে, আশপাশের লোকজন সব ময়লা খালেই ফেলে।’
খালের আরেক অংশ বেড়িবাঁধ সড়কের পশ্চিম দিকে। যা এখন অস্তিত্ব সংকটে। সাত মসজিদ হাউজিং এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের ময়লা ফেলার ঠিকানা রামচন্দ্রপুর খাল। যেখানে কিছুদিন আগেও সাদিক এগ্রোর মতো নামি কোম্পানির খামার ছিল। খামার উচ্ছেদ করা হলেও সে জায়গায় পানির প্রবাহ ফিরে আসেনি।
এর পাশেই জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্ট বাংলাদেশের (ইউল্যাব) স্থায়ী ক্যাম্পাস রামচন্দ্রপুর খালের কোলঘেঁষে৷ তবে বিশাল সাম্রাজ্য গড়তে গিয়ে জেমকন গ্রুপও রামচন্দ্রপুর খাল দখল করেছে।
নবীনগর হাউজিং এলাকার ৭নং সড়কে দুই তলা মার্কেট, আবাসন ব্যবসা, মসজিদ, দোকানপাট, সাদিক এগ্রোর মিষ্টির খামার গড়ে উঠেছে রামচন্দ্রপুর খালের উপর। নবীনগর ৬নং সড়কে ড. ওয়াজেদ মিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজও গড়ে উঠেছে খালের ওপর।
নবীনগর হাউজিং এলাকার নীতি নির্ধারণী কমিটির এক সাবেক নেতা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'এখানে খাল ছিল, এটা অনেকে জানেই না। খালকে এমনভাবে দখল করা হয়েছে, বোঝা যায় না এখানে খাল ছিল। অনেক বড় বড় স্থাপনা খালের উপর গড়ে উঠেছে। পুরো বিষয়টা হাউজিং মালিক, হাউজিং কমিটির মাধ্যমেই হয়েছে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম ঢাকা মেইলকে জানান, খালের সীমানা নির্ধারণে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মীর খায়রুল আলম বলেন, 'সীমানা নির্ধারণের জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের (সেনাবাহিনীর) সময় আছে। তারা আমাদের রিপোর্ট দেবে। এরপর আমরা খাল উদ্ধারের কাজটা করব।'
খালে ময়লা ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, 'জরিমানা করে আসলে সব কিছু সম্ভব না। আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি৷ এর মাধ্যমে আমরা সচেতনতা নিয়ে আসারও চেষ্টা করছি, যেন জনগণ খালে ময়লা না ফেলে।’
কারই/জেবি