শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ক্লাবপাড়ার চিত্র-২

ক্লাবগুলোতে নেই মূল্যবান কোনো জিনিস, ‘লুটপাটে’ আ.লীগ-পুলিশ!

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৪ পিএম

শেয়ার করুন:

ক্লাবগুলোতে নেই মূল্যবান কোনো জিনিস, ‘লুটপাটে’ আ.লীগ-পুলিশ!

# ছয় বছর বন্ধ থাকার সময় চলে লুটপাট
# কয়েক কেজি রুপার সিল টুকরো করে চুরি
# সিলগালার পর ছিল না কোনো নজরদারি
# সব ক্লাব এখন পুরনো ট্রফি-মেডেলশূন্য

২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে রাজধানীর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ছয়টি ক্লাব একযোগে বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর একটি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। এই ক্লাবটি বেশ পুরনো। ১৯৩৭ সালে এর পথচলা শুরু। ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটির সব অর্জন যেন এখন শূন্য। কারণ যত ট্রফি, মেডেল যা ছিল সবকিছু চুরি হয়ে গেছে। এটিসহ ছয়টি ক্লাবেরই মূল্যবান জিনিসপত্র ছয় বছর বন্ধ থাকার সময় লুটপাট করা হয়েছে। এই লুটপাটের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী এবং পুলিশের কিছু সদস্য জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।


বিজ্ঞাপন


গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্লাবগুলো বন্ধই ছিল। ফলে জনসাধারণের এসবের ভেতর প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। তবে ক্ষমতাসীন দলের কিছু সুবিধাভোগী নেতাকর্মী এবং পুলিশের কিছু সদস্য এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্লাবগুলোর যাবতীয় জিনিসপত্র লুট করেন। বাদ যায়নি জানালা, দরজা, গ্রিল, এসিও। ক্লাবটিতে সর্বশেষ ২০১৯ সালে ২৪টি এসি ছিল। এর একটিও এখন আর নেই। এগুলো কখনো রাতের আঁধারে আবার কখনো দিনের বেলাতেই সবার সামনে খুলে নিয়েছে কিছু লোকজন।

ওয়ান্ডারাসর্স ক্লাবে পাকিস্তান আমলে অর্জন করা একটি বড় সিল ছিল। যা ছিল কয়েক কেজি রুপা দিয়ে তৈরি। এটি ভেঙে টুকরো টুকরো করে চুরি করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটির কোনো অর্জনই আর এখন অবশিষ্ট নেই।

club_3

সরেজমিনে ক্লাবগুলো ঘুরে সাবেক খেলোয়াড়, সাবেক কমিটির নেতা এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।


বিজ্ঞাপন


সন্ধ্যার পর ক্লাবটিতে গিয়ে দেখা যায়, তিন বয়স্ক ব্যক্তি বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। পাকিস্তান আমলে অর্জিত রুপার সিল চুরির বিষয়ে জানাচ্ছিলেন ক্লাবটির পুরনো কমিটির সাবেক নেতা এমএ জলিল। তিনি বলছিলেন, আমরা দেখেছি সেই সিল। অনেক বড়। এখন আপনাকে ছবি দেখাতে পারছি না। কয়েক কেজি রুপা লাগানো ছিল তাতে। সেটি ছিল ওয়ান্ডারার্সের বড় অর্জন। আমরা সেটি রেখে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেটিও এখন নেই। বাকি ট্রফিগুলো তো হাওয়া। যারা কমিটিতে এসেছিল তারা ক্লাবটিতে থাকা এসব জিনিসপত্রের কোনো কদর করেনি। মাঝে ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সেগুলো চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এখন কোনো ট্রফি নেই।

club2

ক্লাবটির সাবেক কমিটির একজন জানালেন, ক্লাবে তারা ২০০৮ সালে শতাধিক ট্রফি রেখে যান। সেগুলো ২০১৯ সাল পর্যন্ত অক্ষতই ছিল। তাদের পর দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগের লোকজন। কিন্তু ২০১৩ সালের দিকে যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদ তার লোকজন নিয়ে সব কটি ক্লাব দখল করে নেন। এরপর থেকে শুরু হয় ক্যাসিনো, যা ছিল প্রকাশ্যে। বিষয়টি তখন পুলিশও জানত। কিন্তু প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলত সেই ক্যাসিনো।

তিনি বলছিলেন, খালিদসহ বাকিরা ক্লাবগুলোকে আয়ের উৎস বানিয়েছিলেন। এখান থেকে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন, অথচ ক্লাবকে কিছুই দিতেন না। 
ক্লাবে বসে থাকা তিনজন জানালেন, দেশ স্বাধীনের আগে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ছিল সেরা। তখন পূর্ব পাকিস্তানের এই ক্লাবের সুনাম এশিয়ার অনেক দেশে ছড়িয়েছিল। ১৯৭১ এর আগে মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাব পশ্চিম পাকিস্তানে ফুটবল খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই সময় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বড় একটি কাঠের সাথে কালো রঙের মাঝে রুপার পাত লাগানো সিল। সেই সিলটি আনার পর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে সময়ও এর কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু গত ছয় বছর বন্ধ থাকার সময় ছিল না কোনো নজরদারি। এতে ক্লাবের যত সম্পদ ছিল সব চুরি হয়ে গেছে।

তারা আরও জানান, শুধু ট্রফি চুরি হয়নি, সেই সাথে প্রয়োজনীয় দলিল, কাগজপত্রও চুরি গেছে। ১৯৩৭ সাল থেকে খেলোয়াড়দের মেডেল, ট্রফি ও আয়-ব্যয়ের হিসাবসংক্রান্ত যাবতীয় খাতা ও কাগজপত্র পর্যন্ত গায়েব হয়ে গেছে।

তাদের দাবি, করোনার সময় এই এলাকায় কেউ আসত না। সেই সুযোগে ‍পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন এসব ক্লাবে লুটপাট চালিয়েছে। নিজের মতো করে এসি, ট্রফি ও যাবতীয় জিনিসপত্র খুলে নিয়ে গেছে তারা।

club1

সম্প্রতি ক্লাবগুলো আবার চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করেছে। স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্লাবগুলো দখলে নিচ্ছেন। যদিও এখনো ক্রীড়া অধিদফতর থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু লোকজনও মিলেমিশে ক্লাবগুলো নতুন করে দখলে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। 
গত মঙ্গলবার রাতে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, একটি এসি এনে রাখা হয়েছে। পাশের দুটি টিন সেডের কক্ষ বসার উপযোগী করা হয়েছে। বাকি কক্ষগুলো অন্ধকার।

সেখান থেকে বের হয়ে আশপাশের দোকানিদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানালেন, ক্লাবটি ক্যাসিনোকাণ্ডের সময় সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কিছু লোক সব সময় ঢুকতো ও বাহির হতো। তারা ছিল আওয়ামী লীগের লোকজন। তারাই মূলত এসব জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে গেছেন।

শুধু ওয়ান্ডারার্স নয়, পাশে থাকা আরামবাগ, দিলকুশা, ফকিরাপুল, ভিক্টোরিয়া ক্লাবের চিত্রও প্রায় একই। সেগুলোও যেসব ট্রফি ছিল সব চুরি হয়ে গেছে। এসব চুরি বা খোয়া যাওয়া ট্রফি উদ্ধারে কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। এখন ক্লাবগুলোতে কিছু কক্ষ সংস্কার করে দিনরাত চলছে জুয়ার আসর।

এ বিষয়ে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের ডিসি শাহরিয়ার হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। তবে জেনে বলতে পারব। আর এসব বিষয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করেছে বলেও জানি না। একই কথা জানান মতিঝিল থানার ওসি মহিউল ইসলাম।

এমআইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর