- মাদকের মূল গডফাদার তিনজন
- ছাত্র হত্যা মামলার আসামিও বিহারি মাদক কারবারিরা
- মাঠ খালি হওয়ার অপেক্ষায় মোল্লা এরশাদ
- মাদকের মূল কারবারিরা দিয়েছেন গা ঢাকা
- ক্যাম্প ছেড়েছে পাঁচ শতাধিক মাদক কারবারি
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের মধ্যে চলা সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত প্রায় এক বছর আগে। জেনেভা ক্যাম্পে ইয়াবা নয়, হেরোইন বিক্রি হবে বলে তখন সিদ্ধান্ত হয়। টাকা, ক্ষমতা এবং জনবলের মুখে ভূঁইয়া রাসেল এমন সিদ্ধান্ত অন্য মাদক কারবারিদের ওপর চাপিয়ে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই থেকে সংঘর্ষ শুরু।
বিজ্ঞাপন
প্রথমে দেশীয় ধারালো অস্ত্র, ইট আর পেট্রোল বোমা দিয়ে চলেছে সংঘর্ষ৷ সাত নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ভূঁইয়া সোহেলের সংঘর্ষ সঙ্গী হন তার আপন দুই ভাই রানা ও টুনটুন। তারা নিজেরাও মাদক কারকারি এবং বিভিন্ন মামলার আসামি।
সোহেল পরিবারের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে আরেক মাদক কারবারি মনু ওরফে পারমনুর৷ যাকে পেছন থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন মাদক গডফাদার চুয়া সেলিম।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চলা সেই সংঘাত কেড়ে নেয় এক কিশোরের প্রাণ। ১৩ বছর বয়সী ওই কিশোরের নাম মো. রাসেল। গত ২৫ মে রাতে মাদক কারবারিদের সংঘর্ষ চলাকালে কয়েকটি পেট্রোল বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় দুজন দগ্ধ হন৷ তাদের মধ্যে একজন রাসেল। আহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর মারা যায় ওই কিশোর।
এরপর সংঘর্ষের ময়দানে নামেন চুয়া সেলিম নিজেই। সংঘর্ষে জড়ান আরেক মাদক গডফাদার ইমতিয়াজ। তিনি জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছটুর ছেলে। ভূঁইয়া সোহেলের পক্ষে মাঠে নামে সৈয়দপুরীয়া গ্রুপের বম, নওশাদ ও বাবুরা।
সংঘর্ষ নিয়মিত হলেও থেমে ছিল না মাদক কারবার। মাদককে পারিবারিক ব্যবসায় রূপ দেওয়া সৈয়দপুরী গ্রুপ আর ভূঁইয়া সোহেল গ্রুপ একদিকে সংঘর্ষ চালিয়েছে, আরেক দিকে মাদকসেবীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে মাদক বিক্রি করেছেন।
বড় মাদক কারবারিরা যখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত, তখন ছোটরাও তাদের দল ভারী করতে সংঘর্ষের ময়দানে নামেন। বিরিয়ানির দোকান বন্ধ করে মাদকের আধিপত্যের লড়াইয়ে নামতে দেখা যায় কামাল বিরিয়ানি দোকানের মালিকের ছেলে মো. এরফানকে। একই কায়দায় অস্ত্র হাতে নামেন বোবা বিরিয়ানির দোকানের মালিকের ছেলে মো. ইরফান, ভাগনে সামির।
জেনেভা ক্যাম্পের বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পের পাঁচ শতাধিক মাদক কারবারি এই সংঘর্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাদের সঙ্গে ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে মিরপুর উর্দুভাষী ক্যাম্প থেকেও যোগ দেন কয়েকজন।
আগস্টে ছাত্র হত্যা মামলায়ও আসামি বিহারিরা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে মোহাম্মদপুরে ৪ আগস্ট পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন ১৬ বছরের শিশু ওমর ফারুক। এ ঘটনায় যে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাতে জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারি চুয়া সেলিম ও কলিম জাম্বুকে আসামি করা হয়েছে। যদিও তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আরও পড়ুন
৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে মোহাম্মদপুর, আদাবর থানা লুট করে মাদক কারবারিরা। একই সময় লুট করা হয় গণভবন। এ সময় তারা এই তিন জায়গা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসেন। যা দিয়ে ওই রাত থেকেই শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। এতে ৬ আগস্ট একজন, এরপর আরও পাঁচজন গুলিতে নিহত হন। সবশেষ গত শুক্রবার ভোরে বোমার আঘাতে মারা যান আরও একজন। নিহত সাতজনের মধ্যে একজন শিশু, বাকিদের মধ্যে পাঁচজনই মাদক কারবারি।
জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান
এরইমধ্যে জেনেভা ক্যাম্পে সেনা অভিযান হয়েছে। আটক হয়েছেন বেশ কয়েকজন মাদক কারবারি। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র। ক্যাম্পের বাসিন্দারা গত সেপ্টেম্বর থেকে জেনেভা ক্যাম্পে সেনা অভিযান চেয়ে আসছেন।
সাম্প্রতিক অভিযানের মুখে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান মাদক কারবারিরা। তবে র্যাবের অভিযানে সিলেট থেকে ধরা পড়েন ভূঁইয়া সোহেল। তবে ধরা পড়েননি তার ভাই রানা, তার স্ত্রী শান্তা এবং আরেক ভাই টুনটুন।
সূত্র জানিয়েছে, চুয়া সেলিমসহ অন্যান্য বড় মাদক কারবারিরা কক্সবাজারে আত্মগোপনে রয়েছেন। পারমনুর অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, মাদকের টাকায় শরীয়তপুরে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন মনু। বর্তমানে সেখানেই লুকিয়ে আছেন তিনি।
মাঠ খালি হওয়ার অপেক্ষায় মোল্লা এরশাদ
মাদক নিয়ে যখন জেনেভা ক্যাম্পে আধিপত্যের লড়াই চলছে, তখন অনেকটাই নীরব ক্যাম্পের আরেক মাদক গডফাদার মোল্লা এরশাদ।
বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, বহু মামলার এই আসামি বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। তিনি চাচ্ছেন চুয়া সেলিম ও ভূঁইয়া সোহেল গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দমন হয়ে যাক। এক্ষেত্রে খোলা মাঠ পাবেন তিনি এবং জেনেভা ক্যাম্পে আবারও মাদকের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।
এনকাউন্টার কি সমাধান বয়ে আনবে?
মাদক কারবার জেনেভা ক্যাম্পে উগ্রভাবে মাথাচাড়া দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০১৭-২০১৮ সালে ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল জেনেভা ক্যাম্পের মাদক। সে সময় শীর্ষ কারবারি ছিলেন পঁচিশ, ইশতিয়াক, পাকিস্তানি রাজুরা। তবে ক্যাম্পটিতে আধিপত্য ছিল গাজা ও ইয়াবার।
২০১৮ সালে র্যাবের এনকাউন্টারে মারা যান পঁচিশ। তখন ভারতে পালিয়ে যান আরেক গডফাদার ইশতিয়াক। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভারতেই প্রাণ যায় ইশতিয়াকের। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন পাকিস্তানি রাজু।
এরপর অনেক দিন নীরব ছিল জেনেভা ক্যাম্প। তবে দুই বছর না পেরোতেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন চুয়া সেলিম, ভূঁইয়া সোহেলরা। এক সময়ের মাদকের ফেরিওয়ালারা বনে যান বড় কারবারি।
পঁচিশের মতো দুর্ধর্ষ মাদক কারবারিকে এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার দেওয়ার পরেও যখন মাদক কারবার থামেনি, বর্তমানেও এনকাউন্টারকে সমাধান মনে করেন না অনেকেই। আবার বিষয়টি মানবতাবিরোধী বলেও মনে করেন সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা।
জেনেভা ক্যাম্পকে ঘিরে স্থানীয়দের ভাবনা কী?
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনথ্রোপলজি বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিম রিফাত ঢাকা মেইলকে বলেন, 'বিহারিরা অনেক বছর ধরে এখানে থাকছেন। এখানেই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বাসস্থান। মোহাম্মদপুরের সব অপরাধের পেছনে তাদের দায়ী করা হয়। তাদের সরানো আসলে কোনো সমাধান না। সরকারের উচিত তাদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো আগে দেখা। সমাধানের কথা তাদের সাথে কথা বলেই ভাবতে হবে।'
স্থানীয় বাসিন্দা এবং 'আমাদের মোহাম্মদপুর' নামক সামাজিক সংগঠনের সভাপতি ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারী জেনেভা ক্যাম্প প্রসঙ্গে বলেন, 'মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কর্মসংস্থান তৈরি। আমরা দেখি যে সরকারই আসুক তারা সন্ত্রাস ও মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে আসছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ম্যানেজ করে চলছে। এটা পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে এর বিরুদ্ধে নৈতিক ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।'
ইসমাইল বলেন, 'দ্বিতীয় যে বিষয় এখানকার বেশির ভাগ মানুষই কর্মসংস্থান না পেয়ে মাদক বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া গেলে বেশির ভাগকেই এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যেত। এছাড়া আরেকটি বিষয় আলোচিত, তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিলেও এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আমি ও এলাকাবাসী মনে করেন।'
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, 'দেশে কোনো মাদক প্রবেশ করবে না, এ বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স হতে হবে।'
জেনেভা ক্যাম্প প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মাদক যেখানে থাকবে, সেখানে অন্যান্য অপরাধগুলো তৈরি হয়ে যায়৷ আধিপত্যকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি, মারামারি এগুলো তৈরি হবে।'
তিনি জানান, জেনেভা ক্যাম্প অপরাধীদের অরণ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকেই অন্যত্র অপরাধ করে এসে জেনেভা ক্যাম্পে আত্মগোপন করেন।
এই সমাজ সমাজ বিজ্ঞানী বলেন, 'যাদের এটা নিয়ন্ত্রণ করার কথা। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ এই সমস্যার অংশ হয়েছেন। এ কারণে সমস্যাটা সমাধানও করা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না।'
এনকাউন্টার কোনো সমাধান না বলে মনে করেন এই অপরাধ বিশ্লেষক। বিষয়টিকে বিচার বহির্ভূত হত্যা বলে আখ্যায়িত করেন তিনি।
এক্ষেত্রে সমাধানের পথও বাতলে দেন ড. তৌহিদুল হক। বলেন, 'বিহারিরা আসলে কোন দেশের বিহারি? ভারতীয় নাকি পাকিস্তানি। ইতিহাসগত দিক থেকে বিচার করলে এর সমাধান করা সম্ভব না। আমরা তাদের কখনো দেশের নাগরিক মনে করছি। আবার তাদের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে আমরা তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। এই না পাওয়ার জায়গা থেকে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। তাদের তো বেঁচে থাকতে হবে৷ তখন বৈধ কোনো উপায় না পেয়ে, নিজের দক্ষতা, যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর পরিবেশ না পেয়ে অপরাধের পথেই তাকে অর্থ উপার্জন করতে দেখা যায়। বিহারি ক্যাম্পের বাইরে যারা অপরাধপ্রবণ আছেন, তারা বিহারিদের নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত করে৷ এক্ষেত্রে আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, বিহারিদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'
কারই/জেবি