images

জাতীয়

বছর ঘুরতেই ডায়েরির দাম দ্বিগুণ, বই না ছাপিয়েই পুরো টাকা উত্তোলন

মোস্তফা ইমরুল কায়েস

১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৩৯ পিএম

কৃষিবিষয়ক বই ‘ফলসম্ভার’ এর একটি কপিও ছাপা হয়নি, অথচ বই ছাপানোর বিল হিসেবে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ‘উপসহকারী কৃষি ডায়েরি’ প্রকাশে ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর এর মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এসব লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ‘কৃষি তথ্য সার্ভিসে’ (এআইএস)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জন্য প্রতি বছর ‘এআইএস’-এর প্রেস থেকে ১৩ হাজার ১০০টি ‘উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডায়েরি’ মুদ্রণ করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রকাশিত ডায়েরির পেছনে (২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট) খরচ হয়েছিল ২৫ লাখ টাকার কিছু বেশি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (সর্বশেষ প্রকাশিত) ডায়েরির খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ খরচ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

বিষয়টি যাচাই করতে রাজধানীর নয়াবাজারে মুদ্রণের কাজ ও ব্যবসা করেন এমন কয়েকজনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, একই মানের ডায়েরি প্রকাশে প্রতিটির খরচ পড়বে ২৪০-২৬০ টাকা। তাও আবার দামি ব্র্যান্ডের কাগজে। সেই হিসেবে এখন ১৩ হাজার ১০০ ডায়েরিতে খরচ হবে ৩০-৩৪ লাখ টাকা। অথচ গত বছর এই ডায়েরি মুদ্রণে ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হলেও এবার খরচ দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন

কোটি টাকা জরিমানাতেও থেমে নেই ‘চালবাজি’
‘অবৈধ’ হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাগাম টানা সম্ভব হবে কি?

সরকারি বিধান অনুযায়ী, খরচ তিন লাখ টাকার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ করার কথা। কিন্তু এআইএসের কর্মকর্তারা ‘উপসহকারী কৃষি ডায়েরি’ প্রকাশে ছোট ছোট ভাগ করে (২ লাখ ৯০ হাজার ৮৯০ টাকা ও ২ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকা করে) ৫৪ লাখ টাকার মুদ্রণ খরচ দেখিয়েছেন। ফলে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে হয়নি। আর এর মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টাকা ওঠানোর প্রতিটি বিলে স্বাক্ষর রয়েছে তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা আবু জাফর আল মুনছুরের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন সূত্র দাবি করে, সংস্থাটির উচ্চপদস্থদের নেতৃত্বাধীন একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই কেনাকাটা ও লুটপাট করা হয়েছে।

এক বছরের ব্যবধানে ডায়েরির মুদ্রণ ব্যয় কিভাবে দ্বিগুণেরও বেশি হলো— জানতে চাইলে সংস্থাটির তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা আবু জাফর আল মুনছুর ঢাকা মেইলকে বলেন, কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে।

এদিকে গত অর্থবছরে (জুন, ২০২৩) ‘ফল সম্ভার’ নামের বই প্রকাশ করার নামে তিনটি কোটেশনে মোট ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ টাকার উত্তোলন করা হয়েছে। অথচ বইটি প্রকাশই হয়নি গতবছর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু জাফর আল মুনছুর স্বীকার করেন করোনা ও করোনা পরবর্তী সময়ে কোনো ফল মেলা হয়নি। তাই ‘ফল সম্ভার’ বইও বের হয়নি। কিন্তু বিল ভাউচার করা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই তিনি বলেন, বই প্রকাশ হয়েছে কিনা সবগুলো বিল ভাউচার না দেখে বলতে পারব না। অল্প পরিসরে ১০০ বা ২০০টি বই ছাপা হতে পারে।

তবে গত ১২ ফেব্রুয়ারি কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা জানিয়েছেন, গত বছর (২০২৩) বইটি প্রকাশ হয়নি। আগের বছর কিছু হয়েছিল, সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে কিছু করার প্রক্রিয়া ছিল। এখন পর্যন্ত মনে হয় প্রিন্ট হয়নি। লেখাগুলো রেডি করতে দেরি হচ্ছিল। ওইটা আমরা জুনে (২০২৩) বিল করে রেখেছি। এটা প্রসেসিংয়ে আছে। প্রেস ম্যানেজার ভাল বলতে পারবে, কি অবস্থায় আছে।

এদিকে জানা গেছে, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে গত শনিবার কিছুসংখ্যক বই মুদ্রণ করে এআইএসে আনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি না।

মুদ্রণের কাগজ ও কালি কেনায় অনিয়ম

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মুদ্রণের কাগজ ও কালি কেনায় বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ইতিমধ্যে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৫ টাকার কাগজ ও কালি কিনেছেন তারা। রেনবো ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারের চেয়ে বেশি দাম দেখিয়ে কাগজ ও কালি কেনা হয়েছে।

বিল ভাউচার যাচাই করে দেখা যায়, ২২-৩২ সাইজের পার্টেক্সের এক রিম কাগজ ২ হাজার ৭৪৭ টাকা হারে মোট ৩ হাজার ৫০০ রিম ৯৬ লাখ ১৪ হাজার ৫০৩ টাকায় কেনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডায়রির জন্য এই কাগজের সাইজ ২০-৩০ কেনা হলেও ২২-৩২ সাইজ দেখানো হয়েছে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পুরান ঢাকার নয়াবাজারে কাগজের দাম যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, ২২-৩২ সাইজের পার্টেক্সের এক রিম কাগজের দাম ২ হাজার ১২৫ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসেবে ৩ হাজার ৫০০ রিম কাগজের দাম হয় ৭৪ লাখ থেকে ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই এক ধরনের কাগজেই ২০-২২ লাখ টাকা বেশি দর দেখানো হয়েছে। আরো ৫ ধরনের বিভিন্ন সাইজের কাগজ কেনাকাটাতেও একইভাবে বেশি দাম দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু কাগজ নয়, কালি কেনাতেও প্রায় ৩০ লাখ টাকা জালিয়াতি হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

যদিও বাজার যাচাই করেই কেনাকাটা হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিচালক সুরজিত সাহা রায়।

আরও পড়ুন

৪ পণ্যে শুল্ক হ্রাসের সুফল আদৌ পাবেন কি ভোক্তারা?
‘একটু সময় লাগবে, নেত্রীর কথার বাইরে কেউ যাবে না’

কৃষি ডকুমেন্টারি তৈরিসহ অন্যান্য কেনাকাটায় অনিয়ম

প্রায় দুই ডজন ডকুমেন্টারির তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, সব ডকুমেন্টারি বাইরের প্রতিষ্ঠানের নামে তৈরি করা হয়েছে। এআইএসে ডকুমেন্টারি তৈরির সব সাপোর্ট থাকা সত্ত্বেও বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রমে কয়েকজন কর্মচারীকে প্রাধান্য দেন ডিরেক্টর। তিনি কথায় কথায় বলে থাকেন বর্তমান কৃষি সচিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একাধিক নারী কর্মকর্তাকে শোকজও দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে পরিচালক সুরজিত সাহা দাবি করেন, যারা সম্প্রতি চাকরি ছেড়েছেন তারাই এসব গুজব বা মিথ্যাচার ছড়াচ্ছেন।

তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, আপনি আগামীকাল অফিসে আসেন, দেখে যান। সবকিছু নিয়ম মেনেই করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।

বিষয়গুলো নিয়ে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারকে একাধিকবার কল করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

এমআইকে