দফায় দফায় অভিযান, জরিমানা এমনকি শুল্ক কমিয়েও নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার। নাম মাত্র দু-একটা জাতের দাম কমলেও বাজারে এক কেজি চাল সর্বনিম্ন দামে কিনতেও ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৪৭-৪৮ টাকা। বেশ মোটা জাতের এই চালের ক্রেতাও সামান্য কিছু মানুষ। মাঝারি আকারের চাল কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে অন্তত ৫৫ টাকা। চলতি বছরের শুরুর থেকেই এই চালবাজি চলে আসছে চালের বাজারে। এতে বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরু চালের ৫০ কেজির বস্তা ৩১০০ থেকে ৩৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চাল বা বিআর আটাশ চালের ৫০ কেজির বস্তা ২৫০০ থেকে ২৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গুটি স্বর্ণা বা মোটা চালের বস্তা ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা কেজি হিসেবে যারা কিনেন তাদের আরও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে এসব চাল।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ বাজারে সর্বোচ্চ মোটা চাল স্বর্ণা। কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৭ টাকা হারে। এ বাজারে এর চাইতে কম দামে চাল দেখা যায়নি। একই চিত্র টাউন হল বাজারে। ঢাকার এই বাজারের বিক্রেতাদের ভাষ্য, আটাশ ও মিনিকেট চালের চাহিদা বেশি। বাজারটিতে আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ৬৮ থেকে ৭২ টাকা। নগরীর বাসিন্দাদের একটা অংশ এর চাইতেও কমে চাল খোঁজেন। আয় কম, ব্যয়ের লাগাম টানতে যাওয়া ক্রেতাদের জন্যও দোকানিদের যেন বিশেষ কিছু করার নেই। তবে নগরীর অনুন্নত এলাকায় মিলছে কম দামের চাল।
মোহাম্মদপুরের পশ্চিমে ঢাকা উদ্যান এলাকায় দেখা মিলেছে ৪৮ টাকা কেজি দরের চাল। হাজী জয়নাল আবেদিন মার্কেটের চালের বাজারে এক দোকানি জানালেন ৪৮ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করছেন তিনি। সেবা রাইন্স এজেন্সি নামের চাল দোকানের মালিক শরিফ আহমেদ ঢাকা মেইলকে জানান, তার কাছে এটাই সর্বনিম্ন দামের চাল। কেজি ৪৮ টাকা। এই চালের নাম জানতে চাইলে বিক্রেতা বলেন, মোটা চাল। আলাদা কোনো নাম নেই। বাজারটিতে এই চালের তুলনায় সামান্য সরু চালের মধ্যে রয়েছে পাইজাম। কেজি ৫৩ টাকা। স্বর্ণা ৫০ টাকা। মাঝারি আকারের চালের মধ্যে আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে। সরু চালের মধ্যে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। নাজিরসাইল চালের কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত। প্রায় একই অবস্থা দেখা যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও বাজারে। তবে কিছু হাস্কিং মিলের মোটা চাল গুটি কয়েক দোকানে ৪৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। যার ক্রেতা নেই বললেই চলে।
বিজ্ঞাপন
চলতি বছরের শুরুতে অর্থাৎ গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ও পরে চালকলগুলোতেই চালের দাম কেজিতে ৬-৭ টাকা বেড়ে যায়। খুচরাও বাড়ে আরও বেশি। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে প্রধান এ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সীমিত আয়ের মানুষ চাপে পড়ে। বাজারের অস্থিরতা দেখা দিলে ওই সময় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, নির্বাচনী ব্যস্ততার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে কারসাজি করেছে।
আরও পড়ুন
নির্বাচনের পরে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে জোরে-সোড়েই মাঠে নামে সরকার। গত ১৭ জানুয়ারি খাদ্য ভবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় চালকল মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করেন খাদ্যমন্ত্রী। সেখানে ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই মন্তব্য করে চার দিনের মধ্যে চালের দাম আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের সময় বেঁধে দেন তিনি। ঘোষণা অনুযায়ী ২১ জানুয়ারি থেকেই দেশজুড়ে গুদাম, চাতাল ও পাইকারি দোকানে শুরু হয় একের পর এক অভিযান। পাশাপাশি বাড়ানো হয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযানে অবৈধ মজুতসহ নিয়ম ভঙে জরিমানার খবর আসতে থাকে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সেই সময় থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে মোট তিন হাজার ৩৭০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব অভিযানে বিভিন্ন অনিয়ম, কারসাজি ও মজুদারির অপরাধে মোট এক কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫০ টাকা জরিমানা আদায় করার তথ্য জানান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন।
আগামী ১ মার্চ থেকে দেশের মানুষ বাজারে পরিবর্তন দেখবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেন, ভোক্তা থেকে উৎপাদক পর্যায়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পলিসি বা ভোক্তা অধিদফতর দিয়ে কোনো হ্যারাজমেন্ট (হয়রানি) নয় বরং সাপ্লাই (সরবরাহ) যথেষ্ট রাখা হবে। পাশাপাশি চালের বস্তায় উৎপাদন বছর, তারিখ, উৎপাদন মূল্য, পাইকারি মূল্য ও খুচরা মূল্য লেখা লেবেল থাকবে।
এদিকে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে চার পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যার মধ্যে চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অভিযান শুল্ক হ্রাসের পরেও খুব একটা প্রভাব পড়ছে না চালের বাজারে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, যারা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে তারা ক্ষমতাসীন দলের বেশ ধরে অপরাধ করছে। যারা সিন্ডিকেট করছে, মজুতদার তাদের অধিকাংশই সরকারদলীয় লোক। অভিযান করে, জরিমানা করে আর শুল্ক কমিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোকে আরও কঠোর হতে হবে।
টিএই/জেবি