শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ঢাকা

‘অবৈধ’ হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাগাম টানা সম্ভব হবে কি?

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১১ এএম

শেয়ার করুন:

এবার ‘অবৈধ’ হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাগাম টানা সম্ভব হবে কি?

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বেসরকারি হেলথ কেয়ার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। একতলা ভবনের হাসপাতালটিতে সাইনবোর্ডে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অন্তত ১০ জন চিকিৎসকের নাম উল্লেখ আছে। পাশেই দুটি বড় ব্যানারে দুইজন চিকিৎসকের পূর্ণ বিবরণ ও চেম্বারের সময় উল্লেখ করা। আপাতদৃষ্টিতে হাসপাতালটি সব দিক থেকে ঠিকঠাক মনে হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোনো স্থায়ী চিকিৎসক। উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন হাসপাতালটির নিবন্ধন যাচাই করতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এমনকি হাসপাতালটিতে ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে প্রেসক্রিপশন তৈরি, অস্ত্রোপচার ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করারও প্রমাণ মেলে। এমন অবস্থায় হাসপাতালটিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানাসহ সিলগালা করে দেওয়া হয়।

একইদিনে মুকসুদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রায়হান ইসলাম শোভন ও উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অমিত সাহার নেতৃত্বে একাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। এতে উপজেলার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স হালনাগাদ না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট, প্যাথলজির পরিবেশ নোংরাসহ নানা অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন

লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

শুধু গোপালগঞ্জেই নয়। রাজধানীসহ সারাদেশেই এমন অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য প্রশাসন।

২০২৩ সালে অনিবন্ধিত এসব অবৈধ ও মানহীন বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিনস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে সাময়িক সময়ের জন্য সমস্যা সমাধান হলেও পরে অনেক প্রতিষ্ঠান আবারও আগের অবস্থায় কার্যক্রম চালায়। এমন বাস্তবতায় নতুন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া ডা. সামন্ত লাল সেন অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু লোকবল সংকট ও নিয়মিত মনিটিরিং ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কতদিন এর ইতিবাচক প্রভাব থাকবে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি দিনের পর দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় কীভাবে অবৈধ, ভুয়া প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসক পরিচয়ে লোকজন কাজ করছে তা নিয়েও প্রশ্নের শেষ নেই।

দেশে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো। রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা থেকে বৈশ্বিক মাহামারী করোনাভাইরাসের সময় বেসরকারি এসব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান তাদের প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ দেখিয়েছে। তবে এতকিছুর মাঝেও স্বাস্থ্যখাতে অন্যতম সংকটের নাম বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত। সেবা নিয়ে প্রতারণা, চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সেবার মান নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও এখনও এর বাইরে আছে বেসরকারি, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর একটা বড় অংশ।


বিজ্ঞাপন


health_2
সচিবালয়ে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে প্রাথমিক নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। যাদের অনেকেই এক প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মোবাইল নম্বর দিয়ে ১০ থেকে ১২টি নিবন্ধন করেছে। অনেকের নিবন্ধন নম্বর থাকলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। তবে সারাদেশে অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল আছে ৫ হাজার। এছাড়া ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে অনুমোদন নিয়ে। অপরদিকে অননুমোদিত হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার কত সংখ্যক আছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির কাছে।

কীভাবে চলছে অভিযান কার্যক্রম

জানতে চাইলে এক সপ্তাহ আগের ডাটা তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান ঢাকা মেইলকে জানান, চলতি বছরে চলা অভিযানে সাত শ’র বেশি অবৈধ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় ও জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব অভিযান পরিচালনা করছে। এসব কাজে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সাহায্য করছে। এই অভিযান এখনও চলমান রয়েছে এবং চলবে। আমাদের জনবল সংকট রয়েছে তবে আমরা কাজ চলমান রেখেছি। নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।

গত বছরের অভিযানের পরেও অনেক প্রতিষ্ঠান কীভাবে কার্যক্রম চালিয়েছিল জানতে চাইলে মঈনুল আহসান বলেন, যারা অবৈধভাবে কাজ বা ব্যবসা করে তারা আসলে বৈধভাবে কাজ করতে চায় না। এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। ফলে আমরা বন্ধ করি, পুনরায় তারা আবার একই কাজ করে। এদের কার্যক্রম অনেকটা ফুটপাতের ব্যবসায়ী বা হকারদের মতো। উচ্ছেদ করে চলে গেলেই যেমন তারা আবার বসে যায়, অবৈধ ক্লিনিক মালিকরাও একই কাজ করেন। এজন্য আমরা সবসময় তাদের মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি।

আরও পড়ুন

স্বাস্থ্যখাতে সবখানে আস্থার সংকট কাজ করছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

জনবল সংকটের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার এই পরিচালক বলেন, আমাদের জনবলের কিছু ঘাটতি আছে কিন্তু আমরা চেষ্টা করি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনিটরিংয়ের ভেতরে রাখার। আমরা ধাপে ধাপে জনবল বাড়াচ্ছি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা জনবলের চাহিদার কথা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। কিন্তু এটি আসলে রাতারাতি হওয়ার মতো বিষয় নয়। এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হতে হয়। আমরা চাইলেই লোকবল বাড়ানো সম্ভব নয়। আমরা প্রস্তাব ও চাহিদা দিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয়গুলো যদি উদ্যোগী হয় তাহলে ভালো। না হলে আমরা আমাদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাব।

মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ

অবৈধ হাসপাতালের বিরুদ্ধে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, প্রথমত এটা পরিষ্কার করতে হবে অবৈধ হাসপাতাল বলতে কী বুঝানো হচ্ছে। এগুলো কী লাইসেন্স নেয়নি, মেয়াদ শেষ নাকি অন্য কোনো সমস্যা। এভাবে আসল চিত্রটা গোপন রাখা হচ্ছে। যাদের লাইসেন্স নেই বা নবায়ন করা হয়নি, তারা তা নিতে পারে। কিন্তু সেবার ক্রাইটেরিয়াগুলো ফুলফিল করা হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা না করে যখনই একটা ঘটনা ঘটে, তখন এসব অভিযান চালানো হয়। তখন লাইসেন্স নেওয়ার হিড়িক পরে। লাইসেন্স তো সাথে সাথে হয় না। দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। সুতরাং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা চালু থাকবে।

‘কিন্তু যে সমস্যাগুলো তা থেকেই যায় যেমন যতজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা তা থাকে না, ইকুইপমেন্ট থাকে না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না। এগুলো দেখতে হবে।’-বলেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ।

নিয়মিত মনিটরিংয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে মুশতাক হোসেন বলেন, লাইসেন্স না থাকার সমস্যাই কী সমাধান। তাতে কী আসল সমস্যার সমাধান হচ্ছে? সমাধানে নিয়মিত মনিটরিং করা উচিত। অপারেশন যিনি করছেন তিনি চিকিৎসক কি না, নার্স ছিল কি না, এটি বাদ দিয়ে বৈধ-অবৈধের কথা তুলে একটা বয়ান তুলে ধরা হয়। মানুষ আসলে সার্ভিস পায় না। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও একই সমস্যা রয়েছে। দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত নতুন মেডিকেল কলেজও চলছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তাও দেখা উচিত। কোয়ালিটিটা প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ, প্রতিমাসে দেখতে হবে। লাইসেন্স হলো কি হলো না তা ছোট বিষয়। তা আবেদন করলেও হয়ে যায়।

জনবল সংকটের বিষয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, জনবল সংকটের বিষয়টি সামনে আনতে হবে। জনবল কেন নেই? এটা কী কোন জরুরি কাজ নয়? রেল ক্রসিংয়ের গেটম্যানকে বাদ দিয়ে তো রেল চালাতে পারবেন না। এটা যদি জরুরি হয় তাহলে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকেও লোকবল নিশ্চিত করতে হবে। নয়তো মানুষ সেবা পাবে না।

এমএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর