মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

৪ পণ্যে শুল্ক হ্রাসের সুফল আদৌ পাবেন কি ভোক্তারা?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

৪ পণ্যে শুল্ক হ্রাসের সুফল আদৌ পাবেন কি ভোক্তারা?
ছবি: সংগৃহীত

বাজার সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর ও চালে আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার। এর মধ্যে খেজুরে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ, চালে রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ, তেলে মূসক ৫ শতাংশ ও চিনিতে শুল্ক প্রত্যাহার করেছে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পবিত্র রমজান মাসে বাজারে স্বস্তি ফেরাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এই শুল্ক হ্রাস কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নামমাত্র যে শুল্ক কমানো হয়েছে তা ব্যবসায়ীদের সাথে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর প্রভাব খুব একটা পড়বে না বাজারে। শুল্ক কমার ফলে এসব পণ্যের দাম কমবে এই আশায় ছিলেন ভোক্তারা। এখন তাদের আশায় ‘গুড়ে বালি’ দেখা দিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


গত বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুরে ভ্যাট ও শুল্ক কমানো হয়েছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই দুই পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুবিধা চাল আমদানিকারকরা পাবেন আগামী ১৫ মে পর্যন্ত। তবে এ সুবিধা পেতে আমদানির প্রতিটি চালানের বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার লিখিত অনুমোদন লাগবে।

আরও পড়ুন

বেপরোয়া ‘সিন্ডিকেট’, অসহায় ভোক্তা

তেলের ক্ষেত্রে দেশে পরিশোধিত সয়াবিন এবং পাম তেলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বা ভ্যাট পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপাতত ভ্যাট দিতে হবে না এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের। তবে এ সুবিধা তারা পাবেন আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন এবং পাম তেল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তার মানে সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো হয়েছে। আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

এদিকে, রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। বর্তমানে খেজুর আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ। রমজানকে সামনে রেখে সেটি কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। খেজুর আমদানিকারকরা ১০ শতাংশ কম শুল্কে আমদানির এই সুবিধা পাবেন আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত। এছাড়া পরিশোধিত ও অপরিশোধিত উভয় ধরনের চিনি আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। আগে যা ছিল দেড় হাজার। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক কমিয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা, আগে যা ছিল তিন হাজার। এনবিআর জানিয়েছে, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে এ শুল্ক ছাড় পাওয়া যাবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত।


বিজ্ঞাপন


পরিশোধিত চিনিতে বর্তমানে আমদানি শুল্ক নির্ধারিত তিন হাজার টাকা, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ, এটি ৫ শতাংশ এবং আরডি রয়েছে ৩০ শতাংশ। দুই ধরনের চিনিতে এ শুল্ক–কর কাঠামো ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের চিনি আমদানিতেই ৩০ শতাংশ আরডি প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে এনবিআরকে।

শুল্ক কমায় চলতি সপ্তাহে ভোজ্যতেল ও চিনির নতুন দাম নির্ধারণ হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। আমদানিকারকদের উদ্দেশ্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্দরে থাকা মালামাল দ্রুত খালাস করে বাজারজাত শুরু করুন। যাতে শুল্ক কমানোর সুবিধা সাধারণ ভোক্তা পায়। তেল-চিনির মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তেল এবং চিনির মূল্য আমাদের ট্যারিফ কমিশন নির্ধারণ করে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমদানিকারক এবং উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক পর্যায়ে নতুন শুল্কের প্রভাব অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করবো। রমজান উপলক্ষে সেই দামে বিক্রি হবে।

আরও পড়ুন

সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম কাগজে আছে, বাস্তবে নেই

বর্তমানে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়। ভোজ্যতেল আমদানির ওপর বর্তমানে ভ্যাট রয়েছে ১৫ শতাংশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরকে এই ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার অনুরোধ করেছে।

সরকার শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে। বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে তেল, চিনি, খেজুর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও ডলারের উচ্চ মূল্য চিনির বাজারে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া যে শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে তাতে বাজারে খুব একটা দাম কমবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার পার লিটারে মাত্র ৫৩ পয়সা কমিয়েছে। এটা দিয়ে আর কী হবে? আগে থেকেই লিটারে ৩০ টাকা কমিয়ে আমরা বিক্রি করছি। তিন মাস ধরে পাইকারিতে ২৫-৩০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত তেল ১৭০ টাকা যে নিচ্ছে আমরা বিক্রি করছি ১৪১ টাকায়। আর চিনিতে হলো ৪২-৪৩ টাকা রাজস্ব। সেখানে সরকার প্রতি কেজিতে কমাল ৫০ পয়সা। কোথায় ৪২ টাকা আর কোথায় ৫০ পয়সা। এগুলো তো হলো ব্যবসায়ীদের দুর্ণাম করার একটা পাঁয়তারা।’

Vokta2

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘খেজুর ৮০০-৯০০ ডলারে মানুষ ইনপোর্ট করছে। সরকার ট্যাক্স করে রাখছে ২৫০০ ডলার। হয়ত ১০-১২ টাকা খেজুরের দাম কমাইছে, ১২ টাকা গভর্নমেন্ট ছাড়ে দিছে। কোথায় ৯০০ ডলারের ২৫০০ ডলার ট্যাক্স। এসব তামাশা করে তো লাভ নাই। এখন আর বলে লাভ নাই। সময় শেষ। বর্তমানে বিশ্ববাজারের যে অবস্থা, ডলারের যে অবস্থা। সরকার বলছে, ১১০ টাকায় কিনবা। ১১০ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রি করবা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। ডলার নিচ্ছে ১২৪ টাকা। এটা আরেকটা ফাইজলামি।’

আরেক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চিনিতে যে শুল্ক কমানো হয়েছে, বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম কিছুটা কমতে পারে। তবে তাও নির্ভর করবে কারখানা থেকে কী দামে তেল সরবরাহ হচ্ছে, তার ওপর।

আরও পড়ুন

হুমকি ধমকি অভিযানেও কাজ হচ্ছে না

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ইচ্ছা শুল্ক কমানোর সুবিধা পাবে ভোক্তারা। অথচ সম্প্রতি দেখা গেছে, শুল্ক কমানোর সুফল ভোক্তারা পায়নি, মূলত সুবিধা গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। অন্যদিকে শুল্ক কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যে সময় সরকার শুল্ক কমায় আমরা ওই সময়ও বলেছি আসলে ব্যবসায়ীরা শুল্ক কমানোর জন্য অনেকেই মাল খালাস না করে বসেছিল, ওই সুবিধাটুকু নেওয়ার পরে তারা বলবে, এটা দিয়ে কোনো কাজ কবে না, এটা নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে কোনো সুফল আসবে না। ইতিপূর্বে যে সমস্ত শুল্ক কমানো হয়েছে প্রতিবারেই ভোক্তাপর্যায়ে এটার কোনো সুফল আসেনি। এর আগে একবার শুল্ক কমানো হয়েছিল এবং দাম কমানো হয়েছিল। তার পরের দিন ব্যবসায়ীরা আবার আবেদন করে। বিভিন্ন তালবাহানা করে এর সুফল তারা নিজেরা ভোগ করে, ভোক্তা পর্যায়ে কোনো সুবিধা আসতে দেয় না। এজন্য সরকারকে এটা কঠোরভাবে মনিটরিং করে এর প্রভাব নিশ্চিত করতে হবে।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর