মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৫৯ এএম
বৃষ্টিকে বলা হয়ে থাকে স্রষ্টার বিশেষ করুণা। বৃষ্টিতে শীতলতার ছোঁয়া পায় জমিন। প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে জনমনে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় তা যেন এক আতঙ্কের নাম। সামান্য বৃষ্টি হলেই ভোগান্তির শেষ নেই রাজধানীবাসীর। কিছুক্ষণ ভারী বৃষ্টি হলে পানি জমে নগরের বিভিন্ন এলাকায়। তলিয়ে যায় অলিগলির পথঘাট। টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তখন মহাসড়কগুলো যেন রূপ নেয় মহাসাগরে। প্রশান্তির বৃষ্টি চরম ভোগান্তি নিয়ে আসে এই শহরের মানুষের জন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে একসময় অনেক খাল ও নালা ছিল। যেগুলে ধীরে ধীরে ভরাট বা দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্লাস্টিক ও ময়লা-আবর্জনায় শহরের ড্রেনগুলোর স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দিচ্ছে জলবদ্ধতা।
আরও পড়ুন: ‘উন্নয়নে’র নাগরিক ভোগান্তি
গত ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলের পর থেকে টানা ৫-৬ ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভয়ানক জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয় রাজধানীজুড়ে। হাঁটু পানিতে ডুবে যায় নগরে বেশির ভাগ সড়ক। কোনো কোনো সড়কে কোমর পানি পর্যন্ত আটকে থাকতে দেখা যায়। সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে অফিস শেষে বাড়িতে ফিরতে না পেরে আটকা পড়ে লাখ লাখ মানুষ। সেদিন রাজধানীর মিরপুরে সড়কে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজধানীর নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডসহ নগরীর অনেক এলাকার দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ছয় ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানির বাড়তি চাপ ও ময়লা-আবর্জনায় সুয়ারেজের লাইন বন্ধ হয়ে রাতেই নিউমার্কেটের প্রায় ৫০০ দোকানের ভেতরে পানি ঢোকে। মার্কেটের মূল কাঠামো সড়কের থেকে নিচু অংশে হওয়ায় আশপাশের পানিও এসে জমা হয় সেখানে। সেদিন ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদফতর।
গত শুক্রবারও (৬ অক্টোবর) দুপুরে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। রাজধানীর ফার্মগেট, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, বনানী, নিউমার্কেট, মিরপুরসহ অনেক এলাকার বাসিন্দাদের পোহাতে হয় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি। ওইদিনও নিউমার্কেটের ১নং গেটের সামনে হাঁটু পানি দেখা যায়। তলিয়ে যায় পার্কিংয়ে থাকা গাড়িগুলোর চাকা। ১নং গেটের সামনে দিয়ে অল্প গতিতে কোনো গাড়ি গেলেই পানি প্রবেশ করে মার্কেটে। নিউমার্কেট প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, প্লাস্টিকের বোতলসহ পলিথিন এবং ময়লায় ড্রেনে বৃষ্টির পানি আটকা পড়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
রাজধানীতে জলাবদ্ধতা যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জলাবদ্ধতায় যেমন নগর কর্তৃপক্ষের দায় রয়েছে, তেমনি দায় এড়াতে পারে না নগরের মানুষও। আমরা দৈনন্দিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করে থাকি একটা পর্যায়ে গিয়ে তার সর্বশেষ গন্তব্য হচ্ছে ড্রেন, খাল, নদী সাগর-মহাসাগর। আর এই প্লাস্টিক দূষণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর। এতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্লাস্টিক আমাদের যে কী পরিমাণ ক্ষতি করছে তা কল্পনাও করা যায় না। শুধু চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট বা পানির বোতলই নয়, প্রায় সময় বাসার নানা স্থানে বা ছাদের কোণে ফেলে রাখা হয় ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, অব্যবহৃত আসবাবপত্র। যেখানে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমে বসবাস শুরু করে এডিস মশা। যে মশা ছড়িয়ে পড়ে পুরো মহল্লায়। ঘরে ঘরে শুরু হয় ডেঙ্গুসহ নানা মশাবাহিত রোগ।
আরও পড়ুন: তারের জঞ্জাল নিরসন কতদূর?
রাজধানীর মুগদা বাজার মসজিদের সামনের রাস্তায় প্রায় সময় পানি জমা হয়ে থাকে। সিটি করপোরেশনের ড্রেন সংস্কার কর্মীরা মাঝে মাঝে ড্রেন পরিষ্কার করে দিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার একই অবস্থা দেখা যায়। গত দুই দিন আগে পরিচ্ছন্নকর্মীরা ড্রেন পরিষ্কার করলে সেখানে দেখা যায় ময়লা আবর্জনার অর্ধেকই প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের একজন বলেন, এসব প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন, কাগজ জমা হয়েই ড্রেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে পানি যেতে না পেরে তা উপচে ম্যানহোল দিয়ে রাস্তায় চলে আসছে।
এদিকে অস্তিত্ব সংকটে রাজধানীর আশেপাশের প্রায় সব খাল। দখলে কোনোটি ছোট আবার কোনোটি অবহেলার কারণে পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। অভিযোগ রয়েছে, খাল উদ্ধারে তেমন তৎপরতা নেই সিটি করপোরেশনের। জানা গেছে, একসময় ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। সে সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স-কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ ও খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করে দুই সিটি। তবে এখনো পুরোপুরি সুফল পাওয়া শুরু করেনি নগরবাসী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে একসময় অনেক খাল ও নালা ছিল। যেগুলে ধীরে ধীরে ভরাট বা দখল হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্লাস্টিক ও ময়লা-আবর্জনায় শহরের ড্রেনগুলোর স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়ে গেছে। এ কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দিচ্ছে জলবদ্ধতা।
এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একসময় ঢাকায় প্রচুর খাল ছিল। এখন সেগুলা অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে। সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা নেই। দুই সিটি করপোরেশন শুধু বলে- আমরা এই করব, সেই করব। কিন্তু কাজ করে না কেউ। এখন আমাদের এই খালগুলা উদ্ধার করতে হবে। তিন বছর আগে সিটি করপোরেশন এগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করেনি।’
আরও পড়ুন: দুর্ভোগের অন্ত নেই ডিএনসিসির নতুন ওয়ার্ডগুলোতে
মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে সরকারকে অনেক পরামর্শ দিয়েছি। আমরা একটা জরিপ করেছিলাম- ঢাকা শহরে ৭৮টি খাল ছিল। ১২০ কিলোমিটার খাল নেটওয়ার্ক নাই হয়ে গেছে। কারও কোনো উদ্যোগ নেই। সিটি করপোরেশনকে যে ২৬টি খাল দেওয়া হয়েছে একটা খালও ঠিকমতো উদ্ধার হয়নি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক, নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতিবছরেই ঢাকার জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে বিভিন্ন খাল বিল ভরাট করা হচ্ছে। যার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের যে লোকাল ড্রেনগুলো আছে, যেগুলো দিয়ে পানি খাল হয়ে নদীতে গিয়ে পড়বে, এগুলোর ব্যবস্থাপনার অবস্থা খুবই খারাপ। এই বর্ষা মৌসুমেও প্রচুর কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক হয়েছে। কিন্তু লোকাল ড্রেনগুলোতে সেই রেগুলার মেডিনেট কাজটা হয়নি। সব মিলে ঢাকার যে এই মুহূর্তের অবস্থা, এই পানিগুলো যে নামবে, সিটি করপোরেশনের সেই কাজের গতিও সীমিত হয়ে গেছে।’
আরও পড়ুন: উন্নয়নের ‘দেয়ালে’ আড়ালে প্রকৃতি
এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘একটা নেওয়ার্কের সাথে আরেকটা নেটওয়ার্কের যে সংযোগস্থল, সেগুলো ময়লা-আবর্জনাতে পরিপূর্ণ। ২০ বছর আগেও ঢাকায় জলাশয়-জলাধার প্রায় ১০ ভাগের মতো ছিল। এখন সেটা পাঁচ ভাগের নিচে চলে আসছে। এখন এত কম জলাশয় জলাধার নিয়ে ঢাকার পানিগুলোর গতি ঠিক রাখা সম্ভব না। এত বলার পরেও দেখেন হাতিরঝিলের মতো একটি জলাধার ভরাট হচ্ছে। সবমিলে এই সিচ্যুয়েশনটা হচ্ছে তৈরি করা সিচ্যুয়েশন। তা এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, একটু বেশি বৃষ্টি হলেই ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে।’
টিএই/জেবি