উন্নত বিশ্বের মতো রাজধানী ঢাকাকেও তারের জঞ্জাল মুক্ত করতে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ড করা হবে রাজধানীর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা। শুধু বিদ্যুৎ লাইনই নয়, সেই সাথে ইন্টারনেট, ডিশলাইনসহ সব ধরনের সংযোগ লাইন ভূগর্ভস্থ করা হবে। এরই মধ্যে চীনের জি টু জি প্রজেক্টের আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)।
২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২২ সালের শেষের দিকে জানানো হয় এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। কিন্তু এখন আবার বলা হচ্ছে এই কাজ শেষ হতে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি অথবা ২০২৭ সালের শুরুর দিকে শেষ হতে পারে বলে জানাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান টিবিএইএ’র সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে প্রকল্পের নকশা সম্পন্ন করা হয়। এর মধ্যে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ১৯০ কিলোমিটার বিদ্যুতের ঝুলন্ত তার সরিয়ে মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। যার মধ্যে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার ১১ কেভি ঝুলন্ত তার এবং ৭৫ কিলোমিটার শূন্য দশমিক ৪ কেভি লাইন রয়েছে। সব ধনের ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তারগুলো মাটির নিচে স্থাপন করা হবে।
এছাড়া রাজধানীর সাতমসজিদ রোড, মিরপুর রোড, সিটি কলেজ ও গ্রিনহেরাল্ড স্কুল এলাকাসহ ধানমন্ডির একটি নির্দিষ্ট অংশে কোনো তার দৃশ্যমান থাকবে না। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির পরে কাজের নকশা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চীনা প্রকৌশলীরা তাদের নিজ শহর উহানে আটকে পড়েন। যার ফলে তা বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্থ হয়।
কাজ শুরুর পর্যায়ক্রমে গত বছরের ২৩ নভেম্বর ‘ধানমণ্ডি আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক’ নির্মাণ কাজ শুরু করে ডিপিডিসি। চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ফার্মগেট অফিস প্রাঙ্গণে জাহাঙ্গীরগেট থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত নবনির্মিত ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের আওতায় হাতিরঝিল এলাকায় ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। লাইন স্থাপনের কাজ করতে গিয়ে এক দিকে খোঁড়াখুঁড়ি, অপরদিকে বর্ষা- নগরীর যাত্রীদের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। মূলত হাতিরঝিল সড়ক ব্যবহার করে যেসব যাত্রী দ্রুত গুলশান বা রামপুরা থেকে মগবাজারে পৌঁছাতে চান তাদেরই এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রাস্তাগুলো কর্দমাক্ত হয়ে গেছে এবং প্রায়ই যানবাহন গর্তে আটকে যাচ্ছে। রাজধানীর মগবাজার মোড়ে দেখা যায়, ইতোমধ্যে বৈদ্যুতিক লাইনে প্রবেশ করানো হয়েছে। তবে মাথার অংশে এখনও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
চলমান এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি এন্ড প্রকিউরমেন্ট) আবদুল্লাহ নোমান ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন আমাদের হাতিরঝিল এলাকায় যে কাজটি চলছে সেটা প্রায় শেষের দিকে, তা প্রায় ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। পুরো প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত ৪২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের ধাপে ধাপে কাজ চলছে। পুরো কাজ শেষ হতে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি পার হতে পারে। কোভিড সিচ্যুয়েশনের কারণে কাজ দেরি হয়েছে, যেহেতু এটা চায়নার সাথে জি টু জি প্রোজেক্ট, তাই তাদেরও কিছু বিষয় থাকে। এ জন্য সময় লাগছে।
এর আগে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা আমাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। ধানমণ্ডি আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের নির্মাণ কাজ এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে এর কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। শুধু বিদ্যুতের লাইনই নয়, এর মাধ্যমে ইন্টারনেট, ডিশলাইনসহ অন্যান্য যেসব লাইন আছে সবকিছুই এর মধ্যে থাকবে। এর মাধ্যমে যেমন শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সিস্টেম লসও অনেক কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে ২০২৩ সালের শেষের দিকে ধানমন্ডি আন্ডারগ্রাউন্ড ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু মাঝখানে আমরা এক বছর কাজ শুরু করতে পারিনি। আবার দিনের বেলায় কোনো কাজ করা যায় না। সব কাজ রাতে করতে হচ্ছে। তাই আরও কিছু সময় লাগবে। আশা করছি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা শহরকেই আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে।
বিকাশ দেওয়ান বলেন, এছাড়া ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ শীর্ষক একটি প্রকল্পটির আওতায় নতুন ১৪টি ১৩২/৩৩ কেভি ও ২৬টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ এবং বিদ্যমান ৮টি ১৩২/৩৩ কেভি ও ৪টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। ঢাকা শহরে জমির দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনায় আধুনিক ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ৩৫/৫০ এমভিএ ৩৩/১১ কেভি পাওয়ার ট্রান্সফর্মার স্থাপন করা হচ্ছে। এই ধরনের পাওয়ার ট্রান্সফর্মার বাংলাদেশে এই প্রথম স্থাপন করা হচ্ছে। আর টঙ্গীতে একটি অত্যাধুনিক ম্যাকানাইজড ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করা হচ্ছে যার সঙ্গে ওপেন হ্যাঙ্গার সংযুক্ত থাকবে। বাংলাদেশে এ ধরনের ওয়্যার হাউজ এটিই প্রথম।
কয়েক মাস আগে প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিতরণ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে। ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক তার ও সাবস্টেশন এবং অটোমেশন, সেন্ট্রাল স্ক্যাডা (পাওয়ার প্লান্টগুলো এক নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে কাজ করে স্ক্যাডা) বিতরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। অপটিক্যাল ফাইবারসহ ভূগর্ভস্থ ক্যাবল নেটওয়ার্ক ডুয়েল সোর্সের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
টিএই/এএস