নিশীতা মিতু
২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০১:২৫ পিএম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু’। মাঝেমধ্যে মনে হয় লাইন দুটো আমাদের জীবন থেকেই নেওয়া। চারপাশে কত কী দেখার আছে, তবু বেখেয়ালি মন সব এড়িয়ে যায়। গ্রামে আমার খুব কম থাকা হয়েছে। তবু প্রকৃতি আর মাটির প্রতি আলাদা টান অনুভব করি রোজই।
ছোটবেলায় দেখেছি কারো হাত কেটে গেলে বাড়ির বড়রা কোথায় থেকে যেন কটা পাতা এনে হাতের মধ্যেই ডলে রস বের করে কাটা স্থানে দিতেন। সঙ্গে সঙ্গেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যেত। তখন এই পাতাকে জাদুর পাতা মনে হতো। বড় রাস্তা মানে পিচঢালা যে রাস্তা দিয়ে বড় যান চলে তার দু ধারে এই গাছ রাজত্ব করত। ধুলা পড়ে তার সবুজ রঙ মেটে হয়ে যেত। কখনো পথিকের তাড়া থাকলে পাতা মাড়িয়েই এগিয়ে যেতেন। খেলনাবাটি খেলায় তরকারি হিসেবে এই পাতার হরেকরকম ব্যবহার করত শিশুরা।
এতক্ষণে হয়ত বুঝে গেছেন কীসের কথা বলছি। রাস্তার ধারে, পুকুরের পাড়ে, বনে-জঙ্গলে আপন মনে বেড়ে ওঠা আসাম লতার গুণগান গাইছিলাম। এই নামে নাও চিনতে পারেন। কারণ এর হরেক রকম নাম আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো বিকাশ লতা, জার্মানি লতা, ফিরিঙ্গি লতা, শিয়ালমতি, তিক্ত লতা, রিফুজি লতা, বুড়ি পান লতা। কেউ কেউ একে ক্লাইম্বিং হেম্প ভাইন বা আমেরিকান দড়ি নামে চেনেন। আবার অনেকের কাছে এটি জাপানি লতা নামেও পরিচিত।
আরও পড়ুন- ফুলের নাম ‘নাগচাঁপা’
মিকানিয়া গণভুক্ত একটি উদ্ভিদ আসাম লতা। এই গণভুক্ত প্রায় ৪৫০ ধরনের প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে Mikania micrantha এবং Mikania scandens এই দুটি প্রজাতির। আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। আবার কারো কারো মতে ভারত আর বাংলাদেশই এর আদিম ঠিকানা।
পাহাড় কিংবা পথের ধারে ঝোপের আকারে বেড়ে ওঠে আসাম লতা। বেগুনি আভাযুক্ত ছোট ছোট সাদা ফুলে ভরিয়ে রাখে নিজের শরীর। অতি দ্রুত বর্ধনশীল বলে ইংরেজিতে একে ‘মাইল-আ-মিনিট’ নামেও ডাকা হয়। নাম যাই হোক, অবহেলিত এই গুল্মের কাজের কিন্তু শেষ নেই।
আরও পড়ুন- অবহেলিত ঔষধি গুল্ম ‘চাকুন্দা’
রক্তপড়া বন্ধ করে
শরীরের কোনো অংশ সামান্য কেটে বা ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাত হলে ব্যবহার করতে পারেন আসাম লতা। এর পাতা হাতে ডলে নিংড়ে রস বের করে লাগিয়ে দিন ক্ষতস্থানে। অল্প সময়ের মধ্যে রক্তপড়া বন্ধ হবে, ব্যথাও কমবে।
পচা ঘা সারায়
ক্ষত খুব গভীর নয়, কিন্তু রোজ পুঁজ বের হয়— এমনটা হলে পুঁজ বের করে আসাম লতার রস দিয়ে ক্ষতস্থান মুছে নিন। নিয়মিত দুইবার করে রস লাগালে কয়েকদিনের মধ্যে ঘা সারবে। রস কিছুটা গরম করে নিতে পারলে আরও ভালো।
আরও পড়ুন- হুরহুরে ফুলে ফুরফুরে মন
চুলকানি কমায়
ঘামাচির মতো ছোট ছোট র্যাশ ওঠে অনেকসময় শরীরে। এগুলো ঠিক অ্যালার্জিঘটিত নয় কিন্তু চুলকানি হয় খুব। এমন সমস্যা হলে আসাম লতার পাতার রস ভালভাবে গরম করার পর অল্প গরম থাকতে থাকতে চুলকানিতে লাগালে (প্রত্যহ একবার করে) ৪/৫ দিনের মধ্যে উপদ্রব চলে যায়। তবে ব্যবহারের আগে অল্প একটু কানের পেছনে বা হাতে লাগিয়ে দেখুন। কোনো সমস্যা না হলে সারা শরীরেই ব্যবহার করতে পারেন।
বাতের ব্যথা কমায়
বাতের ব্যথায় ভোগেন না এমন মানুষ কমই আছেন। এই পাতা বেটে হালকা গরম করে প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা দুই-ই কমে।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে
যাদের প্রচুর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা রয়েছে তারা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ লিটার পানিতে ৫-৬টি আসাম লতার পাতা কচলিয়ে সেই পানি পান করুন। গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি মিলবে।
কিডনির পাথর অপসারণ করে
কিডনি ও পাকস্থলিতে পাথর হলে ২-৩ টি আসাম লতা রোজ চিবিয়ে খেলে পাথর আস্তে আস্তে অপসারণ হয়ে যাবে।
হাতের তালু ভালো রাখে
শীতকালে অনেকের হাতের তালুতে চামড়া উঠে খসখসে হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আসাম লতা পাতার রস লাগালে খুব উপকার পাওয়া যায়।
এখানেই এর উপকারিতার শেষ নয়। জন্ডিসের চিকিৎসায় বহুকাল ধরে এই পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। খালি পেটে ৪ চা-চামচ আসাম লতার রস আর ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে ৭দিন খেলে রক্ত দূষণ ভালো হয়। জ্বর, মাথাব্যথার মতো সমস্যা সমাধানে কাজ করে এটি। উপকারি ভূমিকা রাখে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও।
কি অবাক হচ্ছেন? তা আমিও হয়েছি বটে। মনোযোগ দিয়ে কখনো যে পাতা দেখিনি, আয়োজন করে যার যত্ন কখনো নেইনি সেই উদ্ভিদই কী না এত উপকারি! প্রকৃতি আসলে আমাদের ভালোবাসে অনেক কিছুই দেয়। মনোযোগী দৃষ্টিতে তা খুঁজে নিতে হয় কেবল।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
এনএম