images

আইন-আদালত

রাজসাক্ষী পুলিশের মামুন-আফজালুল ক্ষমা পাবেন কি?

আমিনুল ইসলাম মল্লিক

২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:২৫ এএম

গত বছরের জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সহস্রাধিক হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করার অভিযোগের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিচারকাজও চলছে। তবে প্রধান তিন আসামির মধ্যে সাবেক পুলিশপ্রধান অপরাধ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। গত ১০ জুলাই তিনি রাজসাক্ষী হতে লিখিত আবেদন করায় ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করেছে। এছাড়া সাভারে ভ্যানে ছয়টি মরদেহ পোড়ানোর মামলার অন্যতম আসামি আশুলিয়া থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক শেখ আফজালুল হকও ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েছেন। তিনি লিখিত আবেদন না করলেও গত ২১ আগস্ট মৌখিক আবেদন করেছেন।

জুলাই-আগস্টের হত্যা মামলায় পুলিশের এই দুই সদস্য রাজসাক্ষী হওয়ায় এবার তারা কি শাস্তির আওতায় আসবেন না, তাদের শাস্তি কি কমানো হবে কিংবা তাদের কি মুক্তি দেওয়া হবে- এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। রাজসাক্ষীর ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল আইনেই বা কী বলা হয়েছে- সে সম্পর্কেও অনেকের কৌতূহল রয়েছে।

দেশের বিশিষ্ট ফৌজদারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজসাক্ষীর মানে নিজেকে বাঁচিয়ে মামলার অন্যান্য আসামিদের সাজা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। তাদের মতে, পূর্বে অপরাধ করেও রাজসাক্ষী হয়ে খালাস পাওয়ার নজির রয়েছে। তবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও শেখ আফজালুল হকের বেলায় কী ঘটে, তা আগাম বলা সম্ভব নয়।

যে মামলায় রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ৩নং আসামি হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে ৮১ জনকে।

Police3
জুলাই আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ ছিল মারমুখী। ছবি: সংগৃহীত

গত ১০ জুলাই এসব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ গঠনের সময় ট্রাইব্যুনাল-১ জানতে চান, তাঁর (চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন) বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের দায় তিনি স্বীকার করেন কি না? জবাবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি দোষ স্বীকার করছেন। আর অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে তথ্য দিয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করবেন।

সাধারণত অভিযোগ গঠনের সময় আসামি দোষ স্বীকার করলে সেদিনই তাকে সাজা দেওয়া হয়। তবে দোষ স্বীকার করায় বিচারক দয়া করে সাজা কমিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এখানে তিনি দোষ স্বীকার করার পাশাপাশি রাজসাক্ষী দিতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। এখন তিনি রাজসাক্ষী হওয়ায় ক্ষমা পেয়ে মুক্তি পাবেন নাকি কারাগারে থাকবেন- সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।  

অভিযোগ গঠনের দিন ট্রাইব্যুনাল তাকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। আদালত জানতে চান, তাকে যে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তার বক্তব্য কী? তিনি তার দোষ স্বীকার করেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, সে অপরাধের সবকিছু তার জানার কথা। সব তথ্য উদ্‌ঘাটনে ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালকে সহায়তার মাধ্যমে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ হতে চেয়েছেন। সে প্রার্থনা ট্রাইব্যুনাল মঞ্জুর করেন। পরবর্তী সময়ে এ ট্রাইব্যুনালে সুবিধাজনক সময়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনাসহ অপরাধ কাদের মাধ্যমে, কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সে তথ্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করবেন।

আরও পড়ুন

যে রায় ঘিরে শেখ হাসিনার পতন

খায়রুল হকের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান আওয়ামীপন্থীরাও!

পুলিশের এই কর্মকর্তা এখন কারাগারেই থাকবেন। তার নিরাপত্তা-সংকট হতে পারে এমন আশঙ্কায় আইনজীবী আবেদন জানিয়েছেন- তাকে যেন যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সে নিরাপত্তার কারণে ওই দিনই আসামিদের মধ্য থেকে পৃথক করে কারাগারে একক সেলে নেওয়া হয়েছে।

মৌখিক আবেদন শেখ আফজালুল হকের

সাভারের ছয় মরদেহ পোড়ানোর মামলায় চার্জ গঠনের সময় গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ট্রাইব্যুনালে পুলিশ সদস্য শেখ আফজালুল হক দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হতে মৌখিক আবেদন করেন। তবে আবেদন লিখিত আকারে দিতে হবে। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত দিলে তিনি রাজসাক্ষী হতে পারবেন কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।

শেখ আফজালুল হক এই মামলার আসামি ও আশুলিয়া থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক।

অন্যদিকে এই মামলায় সাবেক এমপি সাইফুলসহ ১৬ জনের বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে আলোচিত এ মামলায় পলাতক আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল আইনে রাজ সাক্ষী নিয়ে যা বলা আছে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৫ ধারায় রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করার বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘একজন রাজসাক্ষীর (Approver) ক্ষমা ১৫। (১) বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, ধারা ৩-এ উল্লেখিত যেকোনো অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা গোপনে জড়িত বলে মনে করা হয় এমন যেকোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, ট্রাইব্যুনাল এ শর্তে তাকে ক্ষমা করতে পারে যে, সে অপরাধের সাথে সম্পর্কিত তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ এবং সত্য প্রকাশ করবে এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সকল ব্যক্তির কাছে, যারা মূল ব্যক্তি বা সহযোগী হিসেবেই হোক না কেন, অপরাধ সংঘটনে জড়িত।

(২) এ ধারার অধীনে রাজসাক্ষীর জন্য সম্পৃক্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

(৩) বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যক্তিকে হেফাজতে আটক রাখা হবে।’

ট্রাইব্যুনালের আইনের উল্লিখিত ধারা অনুযায়ী, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন মুক্তি পাচ্ছেন না। এমনকি ক্ষমা পাওয়ার শর্ত হিসেবেও বেশ কিছু বিষয় মানতে হবে।

রাজসাক্ষীর বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধিতে কী বলা আছে?

রাজসাক্ষীর বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৩৩৯ ধারায় বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। রাজসাক্ষী কে হবেন, রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করা ও বিচারপদ্ধতির বিষয় বর্ণনা করা আছে। তাতে বলা হয়েছে, কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা দশ বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ২১১ ধারার অধীনে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ধারা ২১৬ক, ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ ও ৪৭৭ক-এর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটির তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে অপরাধের সহযোগী কোনো ব্যক্তিকে এ শর্তে ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে, অপরাধীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগত বিষয়ে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা যাবে। রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি উপাদান থাকতে হবে যথা ক) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খ) অন্যসব আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা সমর্থিত।

Police2
পুলিশের গুলিতে মারা যায় শত শত মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯ ধারায় রাজসাক্ষী হিসেবে ক্ষমা প্রাপ্ত ব্যক্তির বিচার সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। যদি রাজসাক্ষী তার ক্ষমার শর্ত ভঙ্গ করে, যেমন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় বা তথ্য গোপন করে, তাহলে তার ক্ষমা বাতিল হতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকে তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুর্বল। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে আদালত সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং সার্বিকভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।

রাজসাক্ষী নিয়ে যা বলছেন ফৌজদারি বিশেষজ্ঞরা

সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত ফৌজদারি আইনজ্ঞ এস এম শাহজাহান ঢাকা মেইলকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের ১৫ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ধারায় ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষীর বিষয়টি উল্লেখ আছে। তিনি বলেন, কোনো আসামি অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন এবং নিজেকে দোষী সাব্যস্ত ঘোষণা করেন, তখন অপরাধের সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং সত্য সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে আদালত আসামির সাজা মওকুফ করে দিয়ে তাকে খালাস দিতে পারেন। এ কারণেই আসামিরা অনেক সময় অপরাধ বা দোষ স্বীকার করে নিয়ে রাজসাক্ষী দিতে রাজি হয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন

প্রসিকিউটর পদ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুরিন আফরোজ

আওয়ামী লীগের ‘সুবিধাভোগী’ আইনজীবীরা আদালতে অনুপস্থিত কেন?

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ক্ষমা পাওয়ার শর্তে রাজসাক্ষী হন অপরাধী। রাজসাক্ষীর কন্ডিশনই হচ্ছে ক্ষমা। অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করলে এবং রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন জানালে আদালত সেটি মঞ্জুর করে নেবেন। অর্থাৎ রাজসাক্ষী মানেই অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার ওয়ে বের হওয়া।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিধানসমূহ পর্যালোচনা করে আইনজীবীরা বলছেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও আফজালুল হক জুলাই গণহত্যার অপরাধের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেও বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি পাচ্ছেন না। রাজসাক্ষী হিসেবে তার সাক্ষ্য সঠিক এবং সত্য বলে প্রমাণিত হলে আদালত তাকে ক্ষমা করতে পারবেন। যদি তার সাক্ষ্য মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে ক্ষমা না করে আদালত তার বিচারও করতে পারবেন।

এআইএম/জেবি