বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫, ঢাকা

প্রসিকিউটর পদ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুরিন আফরোজ

আমিনুল ইসলাম মল্লিক
প্রকাশিত: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০৬ পিএম

শেয়ার করুন:

প্রসিকিউটর পদ পেয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তুরিন আফরোজ
উত্তরা থেকে তুরিন আফরোজকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

তুরিন আফরোজ। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ‘গণকমিশন’র সদস্য সচিব এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক সিনিয়র প্রসিকিউটর। প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালনকালে একাধিক বিতর্ক ও অভিযোগে জড়ান তিনি। পৈত্রিক সম্পত্তি একা ভোগদখল করতে নিজের মা এবং ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে বিতর্কিত হন।

তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের পদ ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে আর্থিক সুবিধা হাতিয়ে নিতেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইলও করতেন। এসব অভিযোগে ২০১৮ সালে তাকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়।


বিজ্ঞাপন


২০১৩ সালে তুরিন আফরোজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিয়োগের পর থেকেই তুরিন প্রসিকিউশনের আরেক সিনিয়র সদস্য (বর্তমানে মরহুম) জেয়াদ আল মালুমের সঙ্গে বিরোধে জাড়িয়ে পড়েন। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পরিচয়ে তিনি বিভিন্ন প্রথিতযশা ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করতেন।

প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর বিভিন্ন শিল্প পরিবারের কর্ণধারকে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন। মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হক নামে একজনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে তাকে দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তুরিনের বিরুদ্ধে।

প্রগতিশীল বেশ ধারণ করেও অপরপক্ষের আসামির সঙ্গে দেখা করতেন বোরকা পড়ে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করে অর্থ দাবি করেন তিনি। বিষয়টি ঘাদানিকের তদন্তেও প্রমাণিত হয়। এ প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের মে মাসে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাকে প্রসিকিউশন থেকে সরিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার।

মা-ভাইকেও ছাড়েননি তুরিন


বিজ্ঞাপন


পৈত্রিক সম্পত্তি একা ভোগদখল করতে নিজের মা ও ভাইকেও ছাড় দেননি তুরিন। মাকে জামায়াতের রোকন ট্যাগ দেন। কথায় কথায় মা ও ভাইকে ট্যাগ দিতেন জামায়াত-শিবির হিসেবে।

এ নিয়ে তুরিনের বিরুদ্ধে একাধিক সংবাদ সম্মেলন করেন তার মা সামসুন নাহার তাসলিম। সাংবাদিকদের তুরিনের মা বলেছিলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তুরিন আফরোজ প্রতিনিয়ত সব জায়গায় আমাকে ‘জামায়াতের রুকন’ বলে অপপ্রচার চালায়। এমন অপপ্রচার করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাকে উত্তরার বাসা থেকে বের করে দেয় তুরিন। এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমার বাসা ফেরত পেতে সহযোগিতা কামনা করছি।’

তুরিনের মা আরও বলেন, ‘তুরিন আফরোজ অনৈতিক কার্যক্রম চালাতো। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতো। এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি সেই হতভাগা মা যে তার উচ্চশিক্ষিত মেয়ের হাতে নিগৃহীত হয়েছি।’

আরও পড়ুন

তুরিন আফরোজ চার দিনের রিমান্ডে

সামসুন নাহার তাসলিম বলেন, ‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার ১৮ দিন পর আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয় তুরিন। তার কিছু আচরণের প্রতিবাদ করাই আমার দোষ। আমি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই। আমি আমার দেশ ছেড়ে এ বয়সে কেন বিদেশে পড়ে থাকব? এ দেশ আমার জন্মস্থান। আমার ৫০ বছরের সংসার এখানে। আমি তো এখানেই থাকতে চাই। আমি আমার সংসারে ফিরে যেতে চাই।’

তুরিনের বিতর্কিত আরও যত কাণ্ড

অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা তুরিন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

প্রভাব খাটিয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর শাহনেওয়াজ আহমেদ শিশিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করান তুরিন।

তার আগে ২০১৯ সালের ১৪ জুন উত্তরাস্থ পৈত্রিক বাসভবনে জোরপূর্বক প্রবেশ চেষ্টা এবং নিজের প্রাণনাশসহ হুমকির অভিযোগে মা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জিডি ও পরে মামলা করেন তুরিন। মেয়ের করা মামলায় জামিন নিতে হয় মা সামসুননাহার তাসলিমকে।

২০১৭ সালের ২ মার্চ নিজ মা এবং ভাইকে উত্তরাস্থ পৈত্রিক বাড়ি থেকে বের করে দেন। অসহায় সামসুন্নাহার তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চান। তুরিন ২০১৮ সালের এমপি পদে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান।

তুরিন আফরোজ ও সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে ১১৬ জন ইসলামী চিন্তাবিদ, দেশবরেণ্য আলেম ও হেফাজত নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে তদন্ত চেয়ে অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক পরিচালক উত্তম কুমার মণ্ডল ত্বরিৎ সিদ্ধান্তে অভিযোগের তদন্ত করার জন্য টিম গঠন করেন। পরে অবশ্য দুদক তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে পিছু হাটে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে বিদেশে যান। এরপর দলের অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও এখনো আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা ও দলটির সঙ্গে ঘনিষ্টরা আত্মগোপনে আছেন। তাদের মধ্যে তুরিন আফরোজও ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় তাকে গতরাতে উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আজ আদালতে তুলে রিমান্ড চাওয়া হলে বিচারক চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আদালতে যা বলল রাষ্ট্রপক্ষ

মহানগর পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পক্ষে কথা বলতেন তুরিন আফরোজ। সুপ্রিম কোর্টের যে কয়েকজন আইনজীবী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের অন্যতম তুরিন আফরোজ।

আদালতে যা বললেন তুরিন

শুনানিতে তুরিন আফরোজ আদালতে বলেন, যে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, সেই ঘটনা গত বছরের ৪ আগস্টের। এই ঘটনার আরও আগে থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ ঘটনায় তিনি জড়িত নন।

এআইএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর